প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা

প্রবাসী বাংলাদেশিরা বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তিগুলোর অন্যতম। তাঁদের পাঠানো অর্থই জাতীয় অর্থনীতির বনিয়াদি শক্তি। তাঁরা কত কষ্ট করে, অকাতরে জীবন বিসর্জনের বিনিময়ে দেশে টাকা পাঠান। প্রবাসীরা সবুজ পাসপোর্ট বহন করে চলাচল করেন। দেশে প্রিয়জনদের সঙ্গে তঁারা যত দূরে, যত কষ্টেই থাকুন, যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু সব সময়ই এই প্রশ্ন জ্বলন্ত থাকে, এই রাষ্ট্রের পক্ষে তাঁদের জন্য যতটা করার দরকার, তা কি আদৌ করা হচ্ছে? 

স্বাধীনতা–পরবর্তী ৪০ বছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা কমপক্ষে সাড়ে ১০ লাখ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন বাংলাদেশে। প্রকৃত অঙ্কটি নিঃসন্দেহে এর থেকে আরও অনেক গুণ বেশি হবে। পরিবার ও দেশের জন্য এমন অর্থনৈতিক অবদান রাখতে গিয়ে অকাতরে জীবনও দিচ্ছেন অনেকে। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটেই রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ নগদ সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হয় চলতি অর্থবছরের বাজেটে। কিন্তু এখন খবর বেরিয়েছে যে বাংলাদেশ ব্যাংক যদিও–বা এ বিষয়ে নীতিমালা বের করেছে, কিন্তু তা অস্পষ্ট। এমনকি এ–সংক্রান্ত জারি হওয়া প্রজ্ঞাপন অনেক ব্যাংকারের জানা নেই। হয়তো প্রবাসীরা শেষ পর্যন্ত বঞ্চিত হবেন না, ঘোষিত তারিখ থেকেই ভূতাপেক্ষে টাকাটা পেয়ে যাবেন। কিন্তু যেটা লক্ষণীয় সেটা হলো আমাদের ব্যাংকিং খাতের অসংবেদনশীলতা। তারা সবাই উদ্যোগী ও আন্তরিক হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা নীতিমালার পরে তারা নিষ্ক্রিয় থাকত না। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর যেখানে নিজস্ব স্বার্থ ও স্পর্শকাতরতা থাকে, সেখানে তারা নীতির ধার ধারে না। অথচ এখানে নীতিমালা ও প্রজ্ঞাপন দুটোই আছে, এরপরও যা তাদের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করার কথা, সেখানে ব্যাংকাররা বলতেই পারছেন না যে কবে থেকে প্রণোদনা দেওয়া তাঁরা শুরু করতে পারবেন। 

আমাদের নীতিনির্ধারকদের প্রবাসীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে নিজেদের অভ্যস্ত হয়ে ওঠা
জরুরি। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র যে তার রেমিট্যান্সদাতাদের প্রতি কৃতজ্ঞ ও সংবেদনশীল—সেই রকম একটি বিশ্বস্ত ধারণা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। এর মধ্যে অনেক আবেগ-অনুভূতির প্রশ্নও জড়িত থাকে। স্মরণ রাখা দরকার যে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের একটি বড় অংশ অদক্ষ বা আধা দক্ষ। বিদেশে তঁাদের চাকরি করতে যাওয়াটাই একটা উপাখ্যান। বাড়ির বাইরে পা রাখা থেকে শুরু করে বাড়িতে টাকা পাঠানোর প্রতিটি পর্যায়ে তাঁদের অনেকেই করুণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমধ্যসাগরে নৌকায় পাড়ি দেওয়া, গণকবরের সন্ধান পাওয়া, শত শত কর্মজীবীর লাশ হয়ে ফেরা (গত এক দশকে ২৫ হাজারের বেশি লাশ এসেছে), খারাপ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য থাকার নানা কাহিনি সংবাদমাধ্যমে আসছে। এই মলিন চিত্র কিছুতেই যেন উল্লেখযোগ্যভাবে বদলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ রকম অবস্থায় আমরা আশা করি যে বিদেশের দূতাবাসগুলো প্রবাসীদের কল্যাণে যথাসাধ্য সহায়তা দিতে সর্বদা সংবেদনশীলতার পরিচয় দেবে। প্রবাসীদের কাগজপত্র ঠিক থাকে না বলে অনেকেই বিমুখ থাকেন। বাংলাদেশি শ্রমিকদের দ্বিতীয় গন্তব্য স্থান হিসেবে পরিচিত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের গুরুত্ব সরকারের অজানা কোনো বিষয় নয়। অথচ সেখানকার শ্রমের বাজার বন্ধের পর অভিযুক্ত ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি দিয়েও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। 

আমরা দেশের সুশাসনসংকটে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু আশা করব, প্রবাসী শ্রমিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তারা যেন দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অভ্যাসগত নির্লিপ্ত আচরণ করা থেকে বিরত থাকেন। প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্সে প্রণোদনা দিতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় আচরণ এমন হওয়া সমীচীন নয়, যাতে উল্টো এটা মনে হয় যে সরকার প্রবাসী শ্রমিকদের ব্যাপারে আন্তরিক ও সংবেদনশীল নয়।