চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ

২০১৩ সালের ১০ আগস্ট চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে চলন্ত ট্রেনে ছোড়া পাথরের আঘাতে মারা যান প্রকৌশলবিদ্যার ছাত্রী প্রীতি দাশ। কয়েকজন ‘খেলাচ্ছলে’ চলন্ত ট্রেনের জানালা লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ছিল। তাদেরই একজনের পাথরের আঘাতে মারা যান প্রীতি। তাঁর মৃত্যুর খবর দেশবাসীকে শোকাহত করে তুলেছিল। এর তিন দিন পর অর্থাৎ ১৩ আগস্ট প্রথম আলোয় কবি ও কথাশিল্পী আনিসুল হক ‘প্রীতির জন্য ভালোবাসা’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘প্রীতির মৃত্যু কি থামাতে পারবে ট্রেনে ঢিল ছোড়ার ছেলেখেলা?’ তারও অনেক আগে, আজ থেকে ১৯ বছর আগে ২০০০ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় সাংবাদিক সুমনা শারমীন ট্রেনে ঢিল ছোড়া নিয়ে লিখেছিলেন, ‘এই নিষ্ঠুর তামাশার কি কোনো শেষ নেই?’ 

আনিসুল হক এবং সুমনা শারমীন—দুজনেরই প্রশ্নের জবাব এত বছর পরও ‘না’-তে দাঁড়িয়ে আছে। নানা প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিয়েও সেই ‘না’কে ‘হ্যাঁ’ করা যায়নি। অন্যকে পীড়ন করে পৈশাচিক আনন্দ পাওয়া ধর্ষকামীদের ট্রেনে পাথর ছোড়া থেকে নিবৃত্ত করা যায়নি। ট্রেনে ঢিল ছোড়া ঠেকাতে আইন হয়েছে। পুলিশ মাঝেমধ্যে ঢিল ছোড়ার জন্য কাউকে কাউকে গ্রেপ্তারও করছে। তারপরও ‘খেলাচ্ছলে’ এই ভয়ংকর অপরাধ করে যাচ্ছে তারা। 

গত শুক্রবার ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের জন্য তিনজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে রেলওয়ে পুলিশ। এ নিয়ে গত আড়াই মাসে এই রেলপথে চলন্ত ট্রেনে অন্তত পাঁচবার ঢিল ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। 

প্রধানত কম বয়সী ছেলেরা ‘মজা’ করার জন্য ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারে। কার ঢিল জানালা দিয়ে ঢোকে, এটিই হয়তো খেলার ‘গোল’ থাকে। উদ্বেগের কথা হলো, সম্প্রতি যাদের গ্রেপ্তার হতে দেখা যাচ্ছে, তাদের নাবালক বা ‘অবুঝ’ হিসেবে ধরে নিয়ে অনুকম্পা প্রদর্শনের সুযোগ নেই। তাদের অনেকেরই বয়স ১৮ বছরের ওপরে। 

গল্পের বালকেরা দল বেঁধে খেলাচ্ছলে ব্যাঙদের নিশানা করে পুকুরে ঢিল ছুড়ত। এখনকার ছেলেরা পুকুরের বদলে চলন্ত ট্রেনে ঢিল ছোড়ে। তাদের নিশানায় ব্যাঙ থাকে না, থাকে মানুষ। যারা পাথর ছুড়ছে, তাদের মাথায় এটি কাজ করে না যে ঘটনার শিকার হওয়া ব্যক্তিটি তাদের পরিবারের সদস্যও হয়ে বসতে পারে।

এটি প্রমাণিত হয়েছে, শুধু আইন করে বা দোষী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ বন্ধ করা যাবে না। শুধু রেল কর্তৃপক্ষের হাতে এই দায়িত্ব দিয়ে বসে থাকা কোনো কাজের কথা হবে না। যেসব জনপদের মধ্য দিয়ে রেলপথ গেছে, সেসব এলাকার লোকজন, সমাজকর্মী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব রয়েছে। এর জন্য সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা ঢিল ছোড়ে তারা কী ভয়ংকর খেলা খেলছে, তা তাদের উপলব্ধির মধ্যে আনতে পারলেই এই অভিশপ্ত প্রবণতা কমে আসবে।