চাকরি চাই, কর্ম চাই - তোলো আওয়াজ

সবাই চাকরি নামের সোনার হরিণ ধরতে চান। প্রথম আলো ফাইল ছবি
সবাই চাকরি নামের সোনার হরিণ ধরতে চান। প্রথম আলো ফাইল ছবি

ঢাকা শহরে যে এলাকায় আমি থাকি, তার আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা। প্রতি শুক্রবার সকাল থেকে গেটের সামনে অনেক তরুণ-তরুণীকে জড়ো হতে দেখা যায়। তাঁদের কারও কারও হাতে থাকে চলতি হাওয়ার মতো সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পত্রিকা, কাউকে দেখা যায় ফুটপাতে বসে কোনো একটা পত্রিকার কাটিংয়ে চোখ বুলিয়ে নিতে। দেখতে দেখতে আমি এত অভ্যস্ত হয়েছি যে দেখেই বুঝতে পারি কে সারা রাত জার্নি করে এসেছেন। কোনো কোনো তরুণীর সঙ্গে বাবা বা ভাইকেও দেখি। তাঁরা সবাই সোনার হরিণ ধরতে আসেন—চাকরি নামের সোনার হরিণ। কিন্তু কতজনই-বা সেটা পান? 

বিসিএসের কথাই ধরা যাক। অল্প দিনের ব্যবধানে সিলেট ও কুমিল্লা ঘুরে এসে টের পেয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া, সদ্য স্নাতকদের এক বড় অংশই বিসিএস নামক সোনার হরিণের পেছনে নিজের সর্বস্ব বাজি ধরে বসে আছে। ভাবছেনও না, এই চাকরি পেতে হলে তঁাকে দুই হাজার জনের মধ্যে একজন হতে হবে। সহজ নয় মোটেই। প্রতি ২ হাজার জনের মধ্যে ১ হাজার ৯৯৯ জনেরই কোনো চাকরি এখানে হবে না। আমাদের এখানে বিসিএস পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ব্রুনাইয়ের লোকসংখ্যার বেশি। এই হিসাব শুধু বিসিএসের নয়, ১৮ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের পদে নিয়োগের জন্য পরীক্ষা দিয়েছেন ২৪ লাখ! ২৪ লাখ সংখ্যাটা কত বড়, সেটা আন্দাজ করার জন্য বলতে পারি, বিশ্বের ৮৭টি দেশের জনসংখ্যা এর চেয়ে কম!

এ রকম একটি দেশে গত ১০ বছরে আমাদের মাথাপিছু গড় আয় দুই গুণের বেশি হয়েছে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। আমরা স্বপ্ন দেখছি ২০৪১ সালে আমাদের জিডিপি তিন ট্রিলিয়ন ডলার ছাপিয়ে যাবে। এসবই আশার কথা। 

কিন্তু ছোটবেলা থেকে যে শুনেছিলাম ১ শতাংশ জিডিপি বাড়লে ১৫ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়, তার প্রকাশ তো দেখছি না। ৪৭ শতাংশ স্নাতক নাকি চাকরি পান না। ১০ কোটি ৭০ লাখ কর্মী আমাদের দেশে, অথচ এর অর্ধেকই সে অর্থে কোনো কাজ করেন না বা করার সুযোগ পান না। ২০৩০ সালের মধ্যে তিন কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। সেটা কেমন করে পূরণ হবে? 

একজন ৩০ বছর বয়সী তরুণ বা তরুণীর কাছে জীবনের পরাজয় হচ্ছে, এই বয়সে সেলুনে চুল কাটা কিংবা সিনেমা দেখার টাকাটা মা কিংবা ভাইয়ের কাছ থেকে নেওয়া। কিন্তু তাঁদের কথা কে ভাবে। 

সামান্য কিছু কাজ হলেই কিন্তু অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। সব হিসাব বলছে, আমাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে, এমন লোকের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কাজেই দেশের ১৬ কোটি লোকের চাহিদা মেটানোর জন্যই আমাদের অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। সে জন্য আমাদের প্রায়োরিটি ঠিক করা দরকার। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কটি চার লেনের হয়েছে। ভবিষ্যতে হয়তো আট লেনের করা হবে। কিন্তু সেটা না করে এই কবছরে ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল রেললাইন করতে পারলে কিছু সমীকরণ পাল্টে দেওয়া যেত। এর ফলে অনেক উদ্যোক্তা তখন ঢাকার বাইরে চলে যেতেন নিজের জোগাড়যন্ত্র নিয়ে। তার সঙ্গে যদি হাইস্পিড ইন্টারনেটকে জুড়ে দেওয়া যেত, তাহলে হতো সোনায় সোহাগা। হিসাব বলে, প্রতি এক হাজার ব্রডব্যান্ড কানেকশন নতুন ৮টি কর্মের সৃষ্টি করে। আপনি যদি ঢাকার বাইরে যান, তাহলে দেখবেন উদ্যমী তরুণেরা কতভাবে নিজের ভাগ্য বদলের চেষ্টা করছেন। ব্রডব্যান্ড আর জ্ঞান কী করতে পারে, তার উদাহরণ ভূরি ভূরি বিশ্বজুড়ে। মাত্র ৫৫ জন তরুণ-তরুণী মিলে হোয়াটসঅ্যাপ নামে অ্যাপ্লিকেশন বানাতে পারেন, যার মূল্য মাত্র ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা! আমাদের তরুণদের বানানো ‘দোকান’ নামের ই-কমার্স সলিউশনে বিশ্বের ২৫ হাজার ই-কমার্স সাইট চলে। মানে আমরাও পারি। 

চট্টগ্রামে নদীর ওপারে একটি কোরিয়ান ইপিজেড হয়েছে। সেখানে অনেক কারখানা হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল এক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। ওই এক লাখ লোকের নানান সুবিধা দেওয়ার জন্য আরও ২০ হাজার লোকের নানান রকমের কর্মসংস্থান হতে পারে সেখানে। কর্ণফুলী নদীর নিচের টানেল চালু হলে সেখানে আমরা সরিয়ে নিতে পারি আমাদের গার্মেন্টস জোন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করেও চীনের তৈরি পোশাকমালিকদের পক্ষে আমাদের রেটে কাপড় বানানো কঠিন হয়ে উঠছে। যদি আমরা নজর দিতে পারতাম আমাদের পোশাককর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে, তাহলে সেটি আমাদের রপ্তানি আয় বাড়াতে যেমন সাহায্য করত, তেমনি ওই খাতের বিদেশি কর্মীদের প্রতিস্থাপন করতে পারত। রক্ষণশীল হিসেবে প্রতিবছর বিদেশিরা আমাদের দেশ থেকে নিয়ে যায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ টাকা দিয়ে কত তরুণের কর্মসংস্থান করা যাবে? 

শুধু কর্মসংস্থান কেন? নতুন উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথাও তো আমরা ভাবতে পারি। সরকারি উদ্যোগে লাখ লাখ ছেলেমেয়েকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার আগে দরকার নতুন উদ্যোক্তাদের জীবনকে সহজ করা। আজও এ দেশে ট্রেড লাইসেন্স করতে হলে উদ্যোক্তাকে মিথ্যা কথা দিয়ে শুরু করতে হয়। কারণ, এই একুশ শতকে ডিজিটাল বাংলাদেশে ব্যবসা করার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে ‘বর্গফুটের’ অফিস থাকা। মিরপুর থেকে হাজারীবাগে অফিস স্থানান্তর করলে ভ্যাটের কাগজপত্র স্থানান্তর করতে কমপক্ষে এক মাস সময় লাগে, যথাযথ স্পিডমানি দেওয়ার পরও। কদিন আগে একটি কারখানার মালিকের দুঃখের কথা শুনে হাসব না কাঁদব, তা বুঝতে পারলাম না। কারখানা থেকে মালামাল নিয়ে চার জায়গায় পাঠানোর জন্য তাঁর কাভার্ড ভ্যান বের হয়েছে। রাস্তার জ্যাম ঠেলে তিন জায়গায় মালামাল দিতে দিতে রাত ১২টা পার হয়ে গেছে। ৪ নম্বর দোকানে পৌঁছার পথে ভ্যাট পরিদর্শক গাড়ি আটকে দাবি করেছেন, ভ্যাট চালানের তারিখ ঠিক নেই। কারণ, এটা গতকালের। কী করতে হবে? ‘কারখানায় গিয়ে নতুন চালান করে আনেন অথবা আমারে টাকা দেন।’এমন সংস্কৃতি চালু রেখে আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন, তিন কোটি লোকের কর্মসংস্থান আমরা কখনোই করতে পারব না। 

আর তরুণেরাও যদি কেবল ভাবেন দক্ষতা না বাড়িয়ে কেবল মামা-চাচা দিয়েই কর্ম জোগাড় করে ফেলবেন, তা-ও কিন্তু হবে না। সব তরফের উদ্যোগ, আন্তরিকতা এবং সহায়ক নীতিমালাই কেবল তরুণদের কর্মে ও উদ্যোগে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে। 

মুনির হাসান প্রথম আলোর যুব কার্যক্রমের প্রধান