ট্রাম্পের সৌদি নীতির ব্যর্থতা ধরা পড়ছে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

সৌদি আরবের দুটি বড় তেলক্ষেত্রে গত শনিবার যে হামলা হলো, তা ইরান-সৌদি রেষারেষির সাম্প্রতিক তীব্রতার দৃশ্যমান লক্ষণ। বলা হচ্ছে, সৌদি আরব প্রতিদিন যে পরিমাণ তেল উৎপাদন করে থাকে, এই ড্রোন হামলার কারণে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা বলছে, তারা এ হামলা চালিয়েছে। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও হামলার জন্য ইরানকে দোষারোপ করেছেন। যথারীতি পম্পেওর এ অভিযোগ ইরান অস্বীকার করেছে। 

ট্রাম্প প্রশাসন ছোটখাটো বিষয় নিয়েও লাগাতার মিথ্যাচার করায় পম্পেওর অভিযোগ সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারছে না। ট্রাম্প ও তাঁর ‘পারিষদেরা’ যেভাবে ঘূর্ণিঝড় হারিকেনের ক্ষয়ক্ষতির তথ্যও ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তার পরে এ হামলার বিষয়ে তাঁদের ভাষ্য কেন মানুষ সহজে বিশ্বাস করতে যাবে? 

হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে সৌদি তেলক্ষেত্রে হামলায় যে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে এবং যতটা নির্ভুলভাবে হামলাটি হয়েছে, তাতে এটিকে ইরানেরই কাজ বলে সবার মনে হবে। 

এটি ঠিক যে সৌদির আগ্রাসনে বিপর্যস্ত হুতিরা প্রতিশোধ নিতে সৌদিতে হামলা চালাতে মরিয়া হয়ে আছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো এককভাবে এমন নিখুঁত হামলা চালানোর সামর্থ্য ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা কোনোটিই তাদের নেই। তেহরানের সরাসরি মদদ ছাড়া তাদের পক্ষে এ ধরনের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক পরিচালনা করা সম্ভব নয়। হামলা যারাই চালিয়ে থাকুক না কেন, এটি ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতির ব্যর্থতার আরও একটি জোরালো প্রমাণ। 

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও সৌদি আরবকে দিয়ে একচ্ছত্র খবরদারি করানোর যে নীতি ট্রাম্প নিয়েছেন, সেটিই মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মূল কারণ। 

আগেকার মার্কিন প্রেসিডেন্টরা প্রথম রাষ্ট্রীয় বিদেশ সফর হিসেবে কানাডা অথবা মেক্সিকোকে বেছে নিতেন। এটাই দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। কিন্তু ট্রাম্প সেই রেওয়াজ ভেঙে ২০১৭ সালের মে মাসে রিয়াদ সফর করলেন। সেখানে সৌদি রাজপরিবারের সদস্যরা তাঁকে সর্বোচ্চ মাত্রার তোয়াজ করে অভ্যর্থনা জানালেন। সেখানে তাঁকে কোনো বিক্ষোভের মুখে পড়তে হবে না—এটিও সৌদি সরকার নিশ্চিত করেছিল। (বলা দরকার, সৌদিতে বিক্ষোভ করলে আপনার শিরশ্ছেদ করা হতে পারে)। এ আনুগত্যে ট্রাম্প উদ্বেলিত হয়েছেন। সৌদি সরকার যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সাড়ে ৩৫ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র কিনবে বলে যে ফাঁপা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে (প্রকৃতপক্ষে এই অঙ্ক তিন হাজার কোটি ডলারের কম এবং তার বেশির ভাগ অস্ত্র ট্রাম্পের সফরের আগেই সৌদির কাছে বিক্রি হয়েছিল) তার প্রতিদানে ট্রাম্প মোহাম্মদ বিন সালমানকে যা খুশি তাই করার ‘ব্লাঙ্ক চেক’ দিয়ে এসেছেন। 

আমরা দেখেছি, এর কয়েক মাসের মধ্যেই মোহাম্মদ বিন সালমান নিজেকে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স থেকে ক্রাউন প্রিন্স পদবিতে উন্নীত করতে প্রাসাদ অভ্যুত্থান ঘটান। রাজপরিবারের যে প্রভাবশালী সদস্যরা তাঁর ক্ষমতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন, তাঁদের তিনি আটক করেন। কাউকে গৃহবন্দী করেন, কাউকে জেলে পাঠিয়ে দেন। এর মধ্য দিয়ে নিজের বৃদ্ধ বাবা বাদশাহ সালমানের বিকল্প নেতা হিসেবে নিজেকে দাঁড় করান। তিনি তাঁর ‘অসীম কর্তৃত্ব’ ব্যবহার করে সৌদি নারীদের গাড়ি চালানোকে বৈধতা দেওয়াসহ কয়েকটি ভালো কাজও করেছেন। তবে বেশির
ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি অবিবেচনাপ্রসূতভাবে এ ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন। 

মোহাম্মদ বিন সালমান কাতারের (কাতারও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশ) ওপর অবরোধ জারি করে কাতারের রাজপরিবারের সদস্যদের চাপে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছেন। সৌদি রাজপরিবারের কয়েকজন ধনকুবের সদস্যের অর্থ জব্দ করার জন্য তিনি তাঁদের আটক করেন। ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাধ্য করতে লেবাননের প্রধানমন্ত্রীকে তিনি অপহরণ করেছিলেন এবং সে চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। হুতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান জোরদার করে তিনি ইয়েমেনকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মধ্যে ফেলেছেন। তিনিই যে নির্বাসিত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যার নির্দেশদাতা, সেটি প্রায় নিশ্চিত। 

এই মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রতিটি পদক্ষেপের প্রতি ট্রাম্প অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে আসছেন। বিচার ছাড়াই সৌদি রাজপরিবারের কয়েক ডজন ব্যক্তিকে মোহাম্মদ বিন সালমান কয়েদখানায় ঢোকানোর পর ট্রাম্প টুইটারে বলেছিলেন, ‘সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান ও ক্রাউন প্রিন্সের প্রতি আমার আস্থা অবিচল রয়েছে। তাঁরা ভালো করেই জানেন তাঁরা কী করছেন।’ 

৩৪ বছর বয়সী সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ধারণাও করতে পারছেন না, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ৩৮ বছর বয়সী ‘ক্রাউন প্রিন্স’ জ্যারেড কুশনারের (ট্রাম্পের জামাতা, যিনি মার্কিন প্রশাসনে ট্রাম্পের অঘোষিত প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন) চেয়েও কতটা বেশি ক্ষমতাচর্চা করছেন। 

এরপরও ট্রাম্প সৌদির দোষ ঢেকে যাচ্ছেন। খাসোগি হত্যা ইস্যুতে তিনি মোহাম্মদ বিন সালমানের নাম উচ্চারণ করেননি। ইয়েমেনে সৌদির রক্তক্ষয়ী অভিযান চালানো অনুমোদন করে দুটি বিলে তিনি সই করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শুধু রিয়াদ এবং জেরুজালেমের পরামর্শ শুনে তিনি ইরান চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তার মানে মধ্যপ্রাচ্যে একটি বিস্ফোরণোন্মুখ বারুদের বাক্সের ওপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি। 

তবে সম্প্রতি মনে হচ্ছে ট্রাম্প ইরান ইস্যুতে কৌশল বদলাতে শুরু করেছেন। চরম ইরানবিরোধী জন বোল্টনকে তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে ইরানের সঙ্গে আলোচনা, এমনকি ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করারও একটি আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে সৌদি তেলক্ষেত্রে হামলা ট্রাম্পের সমঝোতার পথকে অনেক কঠিন করে ফেলবে। সত্যিই যদি ইরান এতে জড়িত থেকে থাকে, তাহলে তা হবে তার নিজের পায়ে গুলি করার নামান্তর। 

ইরান যে সন্ত্রাসের মদদদাতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দেশ এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল করার জন্য দেশটির সরকারকে দায়ী করা যেতেও পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ট্রাম্প ইসরায়েল ও সৌদি আরবকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে সেই সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছেন। সৌদি তেলক্ষেত্রে হামলা হচ্ছে ট্রাম্পের আঘাতের জবাবে হানা সর্বশেষ পাল্টা আঘাত। 

ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

ম্যাক্স বুট ইতিহাসবিদ ও ওয়াশিংটন পোস্ট–এর নিয়মিত কলাম লেখক