ইসরায়েলের নির্বাচন: ফিলিস্তিনিদের কিছু এসে যায় কি?

রয়টার্স ফাইল ছবি
রয়টার্স ফাইল ছবি

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যখন পার্লামেন্ট স্থগিত করার পরিকল্পনাটি ঘোষণা করেন, আমি তখন আমার স্ত্রী পেনির সঙ্গে অর্কনিতে বেড়াচ্ছিলাম। স্কটল্যান্ডে মাসব্যাপী থাকার শেষ সপ্তাহ ছিল সেটা এবং আমাদের কাছে খবরটি পৌঁছাতে এক দিন লেগেছিল। একই সময়ে আমি আমার দেশ থেকেও বেশ কয়েকটি খারাপ খবর পেয়েছিলাম। এগুলো ছিল ইসরায়েলি বসতির সম্প্রসারণ, আরও ফিলিস্তিনি এলাকা দখলের হুমকি এবং গাজায় হতাহতের ঘটনা।

জনসন তাঁর দল থেকে ২১ জন এমপিকে বহিষ্কার করার কয়েক দিন পর আমরা বাড়ি চলে এলাম। বিমানবন্দর থেকে যে চালকটি আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি পথে তিনটি চৌকি পার করে ঘুরপথ ধরে রামাল্লাহয় পৌঁছান। প্রতিটি চেকপয়েন্টে আমরা আমাদের শ্বাস রুদ্ধ করে রেখেছিলাম এবং মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম যেন সেনাদের খারাপ মেজাজ না থাকে। আমাদের গাড়ির চালক জানান যে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জেরুজালেম থেকে কালানদিয়ার কুখ্যাত চেকপয়েন্ট দিয়ে পশ্চিম তীরে আর গাড়ি প্রবেশ করতে দিচ্ছে না, তারা চালকদের ঘুরপথ
দিয়ে যেতে বাধ্য করছে। এতে তাঁরা নানা ধরনের ঝামেলায় পড়ছেন।

চালকের দেওয়া অন্য সংবাদটি হলো ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিজয়দৃপ্ত পদক্ষেপে পুরোনো শহর হেবরনে যাওয়া-সংক্রান্ত। সেখানে তিনি ইব্রাহিমি মসজিদের সামনে বক্তৃতা দিয়েছেন। এই হেবরন শহর মুসলমান ও ইহুদিদের কাছে পবিত্র স্থান। ২০০০ সালে আল-আকসা মসজিদে অ্যারিয়েল শ্যারনের উসকানিমূলক পরিদর্শন দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সূচনা করেছিল। তবে এবার ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ আগেই স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নেতানিয়াহু ৮০০ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের এই আশ্বাস দিয়েছেন যে দুই লাখের বেশি ফিলিস্তিনির শহরে যাঁরা কর্তৃত্ব করছেন, তাঁরা ‘চিরকাল সেখানেই থাকবেন’। এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এই অঞ্চলে তাঁর প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি তুলে ধরেন। তাঁর হেবরন শহর সফরের আসল উদ্দেশ্য ছিল আসন্ন নির্বাচনের আগে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ানো। তবে এটা প্রমাণ করেছে যে ইসরায়েল তার অধীনে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর ওপর কতটা কর্তৃত্ব করেছে।

কয়েক সপ্তাহ বাইরে থাকার পর যখনই আমি রামাল্লাহয় ফিরে আসি, তখন আমি হতবাক হয়ে যাই এই দেখে যে আমার পৃথিবী কতটা সংকুচিত হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনি শহরগুলোতে আমাদের চলাচল এখন সীমিত হয়ে পড়েছে এবং গাজায় যাওয়া তো এখন অসম্ভব একটি ব্যাপার। গাজা রামাল্লাহ থেকে প্রায় ৫০ মাইল দূরে, আমি গত ১৯ বছর সেখানে যাইনি। অসলো চুক্তি দিয়ে ফিলিস্তিনি অঞ্চলকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ‘এরিয়া সি’ ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন, ‘এরিয়া বি’ ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের যৌথ সুরক্ষা নিয়ন্ত্রণাধীন এবং ‘এরিয়া এ’ সবচেয়ে ছোট-ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা রামাল্লাহর আশপাশের জমিসহ ইসরায়েলি প্রশাসনের অধীনে থাকা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের আরও বেশি এলাকা দখল করেছে। এভাবে দখলের কোনো আইনগত ব্যাখ্যা ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা দেয় না। এটি এখন বাইবেলের মতো। তারা ঘোষণা দিয়েছে, ‘ফিলিস্তিনিরা মালিকানার প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারলেও এই দেশ আমাদেরই, কারণ, ঈশ্বর আমাদের তা দিয়েছেন।’

রামাল্লাহ এখন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মূল রাজধানী। এটি এখন মানুষের ভিড়ে ভারাক্রান্ত, কিন্তু তারা কোনো রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করে না। আমাদের ফিরে আসার কয়েক দিন আগে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রধান মাহমুদ আব্বাস ঘোষণা দেন যে ফিলিস্তিনকে তিনটি ‘অঞ্চলে’ ভাগ করার সিদ্ধান্তটি তিনি বাতিল করবেন এবং গোটা পশ্চিম তীরকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সার্বভৌমত্বের অধীনে রাখবেন। তবে এটি একটি ফাঁকা ঘোষণা ছিল, কেননা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ কখনোই এটি বাস্তবায়ন করতে পারবে না। গত জুলাই মাসে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেমে কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি অ্যাপার্টমেন্ট ভেঙে দিয়েছে, যেখানে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা ছিল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের এটা বন্ধ করার কোনো ক্ষমতা ছিল না। গত সপ্তাহে নেতানিয়াহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে পুনর্নির্বাচিত হলে তিনি জর্ডান উপত্যকাসহ পশ্চিম তীরের এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন। এটি ছিল আরেকটি নির্বাচনী স্টান্ট। বাস্তবে পশ্চিম তীর ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমি আশা করেছিলাম এডিনবরার পার্কগুলোর মতো রামাল্লাহর চারপাশে থাকা পাহাড়গুলোর মধ্যে একটি পাহাড়কে পার্কে পরিণত করব। তবে এখন মনে হচ্ছে সেটা করা অসম্ভব। এই জনাকীর্ণ শহরে এখন শ্বাস ফেলার মতো কোনো খোলা জায়গা নেই।

৫০ বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েল এই দখলদারি চালিয়ে যাচ্ছে। এই ৫০ বছরে আমাদের স্বাধীনতা প্রতিদিন সংকুচিত হয়েছে। ইসরায়েলের নির্বাচনে নেতানিয়াহু না জিতলেও আমাদের ভূখণ্ডে ভবিষ্যতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে না।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
রাজা শেহাদেহ: ফিলিস্তিনি লেখক ও আইনজীবী