ভালো ব্যবহারে পয়সা লাগে না

সৌজন্যে সুবাতাস বহে। পরিবেশে মিষ্টি সুবাস ছড়ায়। একটু সুব্যবহার সৌহার্দ্য গড়ে তোলে। সে রকম আতিথেয়তায় যাতনা থাকলেও সুখ।

একবার এক লোক শহর থেকে গ্রামে যাচ্ছেন। ভরদুপুরে প্রকৃতি ডাক দিল। বড় ডাক! রাতবিরেত হলে না হয় খেতের আল বা ডোবার ধারে বসা যেত। ফকফকা আলোতে যাবেন কোথায়?

ছুটে গেলেন এক গেরস্ত বাড়িতে। কিন্তু সে বাড়িতে প্রচলিত ছোট ঘরটি নেই। বাড়ির পেছনে জঙ্গুলে জায়গা, যা স্থানীয়ভাবে ‘আড়া’ নামে পরিচিত, সেখানেই কাজ সারে সবাই। গেরস্ত সবিনয়ে জানালেন তাঁর সীমাবদ্ধতার কথা। শহুরে ভদ্রলোকের এখন-তখন অবস্থা। তিনি ওই ব্যবস্থায়ই রাজি।

কিন্তু গেরস্তের পানি খরচার ঘটিখানা মাটির। শহুরে অতিথিকে সেটা দেবেন কী করে? তাই গিন্নিকে হেঁকে বললেন, ‘কাঠের বাকসো থন পিতলের ঘটিটা বাইর করো।’

কিন্তু পিতলের ঘটিতে একটু ময়লা লেগে আছে। গিন্নি কুয়ার ধারে বসে ছাই দিয়ে মাজতে লাগলেন ওটা।

তা অতিথির অবস্থা যাই হোক, গেরস্তের সৌজন্যে যে নিখাদ আন্তরিকতা, তা অতুলনীয়! একজন অচেনা সাহায্যপ্রার্থীকে খুশি করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। এর পেছনে আর কী আছে, গভীরভাবে তা ভেবে দেখেননি।

ভিন্ন সংস্কৃতির প্রভাব আর আধুনিকতার ধারায় মানব সমাজে প্রচলিত রীতিগুলো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে যায়। এর সঙ্গে সৌজন্যেরও রকমফের হয়। বদলে যায় মানুষের আচরণ।

এক কচুতেই কত কাহিনি! কেউ কিছুতে ফেল মারলে টিটকিরি ছোড়া হয়, ‘এখন বসে বসে কচু খাও!’ কিংবা ‘কচুগাছের সঙ্গে ফাঁস দাও!’ আবার কাউকে কলা দেখাতে বলা হয়, ‘তুমি আমার কচু করবে!’

একসময় কচুকে বেহুদা কিসিমের উদ্ভিদ ভাবা হতো। এ জন্যই এত তুচ্ছজ্ঞান। পরে যখন দেখা গেল, পুষ্টির বিরাট আধার কচু, আয়রনের ডিপো, তখন এই কচুকে আর পায় কে? এক লাফে উঠে গেছে ধনী-গরিব সবার মাথায়। ঢাকার সবজির বাজারে কচুর দাম যাচাই করলেই এর প্রমাণ মিলবে।

একসময় বুড়ো আঙুল প্রদর্শন ছিল চরম অবজ্ঞার বিষয়। তর্কের সময় কেউ তেড়িবেড়ি করলে অপরজন বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে বলত, ‘তুই আমার এইটা করবি!’ এটা অবশ্য এখনো দেখা যায়।

একটা সময় ছিল, যখন শহর বা গ্রামে মুরব্বি শ্রেণির কাউকে বুড়ো আঙুল দেখালে আর রক্ষে ছিল না। ‘নন্দদুলাল’ কেউ পরীক্ষায় ফেল মেরে মাথা নিচু করে বাবার সামনে এলে তিনি তর্জনী তুলে বলতেন, ‘যাও, এখন বসে বসে বুড়ো আঙুল চুষো গে!’

এখন সে বুড়ো আঙুলে চড়ে বসেছে পশ্চিমা রীতি। বুড়ো আঙুল তুলে ধরা মানে ওকে, ঠিক আছে। ফেসবুকে লাইক দিতে ওই বৃদ্ধাঙ্গুলেই ক্লিক করতে হয়। ইউটিউবে দেখা যায়, স্ট্রিট ফুডের গুষ্টি উদ্ধার করা ভিন দেশি ফুড র‌্যাঞ্জার পুরান ঢাকার রেস্তোরাঁয় ঐতিহ্যের স্বাদ নিয়ে বুড়ো আঙুল নাচাচ্ছেন আর বলছেন, ‘বালো, খুব বালো!’

‘বুড়ো’ আঙুলের সেই আগের চল থাকলে তাঁর এই ‘খুব বালো’ ছুটে যেত।

অনেকে চাকুমচুকুম করে খেতে পছন্দ করে। আবার কারও সুড়-ত সুড়-ত করে চুমুক না দিলে চা পানে জুত হয় না। তাদের সঙ্গে জাপানে নুডলস খাওয়ার রীতি বেশ মানিয়ে যায়। জাপানিরা এমনিতে খুব বিনয়ী ও ভদ্র। অতিথিকে মাথা নুইয়ে সম্মান জানায়। কিন্তু নুডলস দিলে এমন শব্দ করে খাবে, মনে হবে যে অভদ্রের একশেষ। এই শব্দ করে খাওয়াটা কিন্তু ভদ্রতা। প্রচলিত রীতি। শব্দ না হলে বোঝা যাবে না খাবারটা খুব উপাদেয় হয়েছে—অতিথি মজা করে খাচ্ছে।

নাক উঁচু জাতি বলে বদনাম আছে জার্মানদের। অন্যদের তেমন পাত্তা দেয় না তারা। কিন্তু ট্রাফিক আইন মেনে চলায় তারা এক নম্বর। সেখানে ঘড়ির কাঁটা ধরে নিখুঁতভাবে সময় মেনে চলে সব গাড়ি। ১০টার ট্রেন মানে ১০টা। গন্তব্যেও পৌঁছাবে নির্দিষ্ট সময়ে। সবচেয়ে ভালো ট্রাফিক আইন মেনে চলেন পথচারীরা। আর তা মানেন রাস্তার বাতি দেখে। বাতির সংকেত যদি থেমে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত করে, রাস্তা ফাঁকা থাকলেও কোনো পথচারী পার হবেন না। আমাদের এখানে হাতের কাছে পদচারী-সেতু রেখে শাঁ শাঁ করে ছুটে চলা যানবাহনের মধ্যে পথচারীদের বাউলি কেটে, কাঁটা তারের বেড়া ডিঙিয়ে, রাস্তা পার হতে দেখলে মুণ্ডু ঘুরে যাবে ওদের।

সুইজারল্যান্ডে আলপস পর্বতমালার পাদদেশে গ্রামীণ সমাজে গড়ে উঠেছে সততার স্বাক্ষর রাখা দারুণ এক রীতি। সেখানে ছোট ছোট দোকানে হরদম পাওয়া যায় টাটকা দুধ, পনির, মধু, পাউরুটি, মাখন ইত্যাদি। বেশির ভাগই দুগ্ধজাত পণ্য। প্রতিটা জিনিসের গায়ে দাম লেখা আছে। ক্রেতা নির্দিষ্ট দামে জিনিস কিনে ঝুড়িতে টাকা রেখে আসবেন, দেখভালের কেউ নেই।

স্থানীয় খামারিরা এসব দোকানের মালিক। দিনের শুরুতে নিজ নিজ দোকানে টাটকা পণ্য রেখে যান তাঁরা। খামারে ফিরে গবাদিপশুর পরিচর্যা করেন, মাঠে নিয়ে যান। বিকেলে দোকানে ফিরে আবার হিসাব বুঝে নেন। পুরো বিষয়টিই ক্রেতার সততার ওপর নির্ভরশীল, যা অনেক দিন ধরে অটুট।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী রেলস্টেশনে এক হকারের এমন একটি দোকান রয়েছে বলে খবর পড়েছিলাম। হামিদুর নামের এক হকার তাঁর এই দোকানে লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালে, রুমালÑএসব বিক্রি করেন। সকালে দোকান খুলে তিনি বেরিয়ে যান নিজ পেশায়। সেখানে একটা বাক্স রাখা আছে। ক্রেতা গিয়ে ট্যাগে লেখা দাম দেখে পণ্য কিনে টাকাটা ওই বাক্সে ফেলেন।

রাজধানীর একটি স্কুলেও শিক্ষার্থীদের বই, খাতা, কলমের জন্য খোলা হয়েছে এমন একটি ‘অনেস্টি শপ’। যেখানে বিক্রেতা নেই আছে শুধু ক্যাশ বাক্স। দেশের আরও কয়েকটি জায়গায় রয়েছে এমনই সততার দোকান। এই রীতি সারা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে মন্দ হয় না। মানুষ যখন নিজের কাছে দায়বদ্ধতা অনুভব করে, সততা এমনি চলে আসে। তবে ঢাকার জিঞ্জিরা, কমলাপুর, গাবতলী, সায়েদাবাদ, সদরঘাট বা চানখাঁর পুলের মতো জায়গায় এভাবে দোকান খুলে উদোম রাখলে কী হবে, তা বলা যাবে না।

বিশ্বে আদব-কায়দায় ব্রিটিশদের সুনাম রয়েছে। উঠতে-বসতে সৌজন্য। কথায় কথায় ‘স্যার’ আর ‘সরি’। রাস্তায় কখনো তারা থুতু ফেলবে না। সবার সামনে আঙুল দিয়ে নাক খোঁচাবে না। আর অচেনা কারও দিকে বিব্রত করার দৃষ্টিতে তো তাকাবেই না। কারও বিরক্তির কারণ হয়ে কিছু করবে না। তবে তারা অতিথিসেবায় মাপজোখ করেই চলে। হ্যাঁ, আদর-আপ্যায়ন করবে ঠিকই, কিন্তু আতিশয্য বলে কিছু নেই।

আদব আর অতিথিসেবায় আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্যের লোকজনের বেশ সুনাম রয়েছে। ভিনদেশি অতিথিকে তারা খুব খাতির করে থাকে। মিসিসিপি, আলাবামা, জর্জিয়া, সাউথ ক্যারোলাইনা বা অন্য কোনো দক্ষিণাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্যের মানুষও কথায় কথায় ‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’ বলতে অজ্ঞান। এর সঙ্গে ‘প্লিজ’ আর ‘থ্যাংক ইউ’ তো আছেই। বন্ধু বা আগন্তুককে উষ্ণ করমর্দন আর আন্তরিক হাসিতে অভ্যর্থনা জানায় তারা। পরোপকারে থাকে এক পায়ে খাড়া। কিছু দেওয়ার বিনিময়ে কিছু পেতে হবে, এ ধারণায় বিশ্বাসী নয়। সামান্য মাংসের চপ দিয়ে অতিথিকে তুষ্ট করার কথা ভাবতেই পারে না তারা। কয়েক পদের খাবারে আনুষ্ঠানিক ভোজ দিয়ে তবেই তৃপ্তি। আর কোনো কারণে যদি মনে হয় যে অতিথি খুশি হয়নি, তবে আফসোসের শেষ নেই।

অতিথিপরায়ণ বলে তুর্কিদেরও সুনাম রয়েছে। অচেনা লোকজন সাহায্যপ্রার্থী হলে নানাভাবে সহযোগিতা করে থাকে। প্রয়োজনে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতেও কসুর করে না। অতিথিকে পরিবেশন করে এত্ত এত্ত খাবার। এর মধ্যে কাবাবই থাকে কয়েক পদের।

আমাদের এই উপমহাদেশে আফগানদের সুনাম রয়েছে আপ্যায়নে। সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর বিখ্যাত ‘প্রবাস বন্ধু’ গল্পে রেখে গেছেন এর নজির। শ্রীলঙ্কা ঘুরে এসে অনেকেই বলেছেন ওদের বিনয় আর আতিথেয়তার কথা। ভারতে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। কাজেই সেখানে একেক রাজ্যের রীতি ও সৌজন্য একেক রকম। তবে পাশ্চাত্য কমবেশি সব জায়গায়ই জেঁকে বসেছে। নেপালি আর ভুটানিরা কেমন, বছরজুড়ে পর্যটকের ঢলই তা বলে দেয়।

আমাদের অতিথিপরায়ণতার কথা আর কী বলব? নিজেদের কথা কি আর গালভরে বলা যায়? মমতা দিদি সাক্ষী। সেই যে তিনি নিমন্ত্রণে এলেন, ইলিশের ডিম আর পাবদার ঝোলসহ কত পদই না ছিল? অস্বীকার করতে পারবেন?

তবে হ্যাঁ, বাইরে থেকে অতিথি এলে বুড়িগঙ্গায় কখনো নৌবিহারে নেওয়া যাবে না। দূষণের ক্যানসারে আক্রান্ত বুড়ি মায়ের অভিশাপে অনর্গল বমন হতে পারে। আর অতিথিকে ঢাকা সিটির লোকাল বাসে ভুলেও তোলা যাবে না। এখানে যাত্রীদের সাদরে তুলে নিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নামানোর যে বিচিত্র সৌজন্য, তা দেখে ভিন দেশি কোনো অতিথির ভিরমি লেগে যাবে।

যখন জমিদারি প্রথা ছিল, তখন নায়েব বা কোতোয়ালকে পুকুরের বড় রুইটা, বাগানের সবচেয়ে সুস্বাদু ফলটা, পালা রাতা মোরগটা না দিলে উপায় ছিল না। এখনো কোনো দপ্তরে দক্ষিণা ছাড়া কিছু হয় না। এটা সেই অবস্থার বিবর্তন মাত্র, পরিবর্তন নয়। কাজেই এ কালচার বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু আচরণটা ভালো হবে তো?

কোনো কোনো ব্যাংকে গিয়ে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নিজের নয়, অন্যের জমানো টাকায় ভাগ বসাতে যাচ্ছি। তখন এ প্রশ্ন জাগাটা খুবই স্বাভাবিক, ভালো ব্যবহারে তো পয়সা লাগে না, তাহলে সদাচরণে সমস্যা কী?

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক ও সাহিত্যিক।
[email protected]