বাঘে-কুমিরের লড়াইয়ে বিভ্রান্ত হরিণশিশু

অর্থনীতির অঙ্গনে পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে চীনের ধারাবাহিক উত্থানের ফলে বাণিজ্য-ভারসাম্যে চিড় ধরলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতির রাশ টানার জন্য তিনটি পন্থা অবলম্বন করা জরুরি হয়ে পড়ে। এক, চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি কমানো অথবা চীনে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি বাড়ানো। দুই, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিক্রি করে সার্বিক ব্যালান্স অব পেমেন্ট-এ ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা। (অর্থাৎ চীনের বাণিজ্য-উদ্বৃত্ত মার্কিন ট্রেজারি বিল ক্রয়ে আবদ্ধ না রেখে মার্কিন ভূখণ্ডে সম্পদ ক্রয়ের মাধ্যমে চীনা বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি।) এবং তিন, বিদেশের মাটিতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক খাতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ব্যয় কমানোও অবশ্যকরণীয় বলে গণ্য করা হয়। এই তিনটির এক বা একাধিক উপায় কার্যকর করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের মতো একজন প্রেসিডেন্টের প্রয়োজন ছিল, যাঁর পুরোনোকে আঁকড়ে থাকার দায় ছিল না, যেমনটি প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের ছিল। 

২০১৬ সালের ১০ নভেম্বরের এক আলোচনায় ট্রাম্পের আগমনকে আমি এই আঙ্গিকে দেখেছিলাম। শুরুতে আমদানিনির্ভর যুক্তরাষ্ট্রীয় নাগরিকের স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে শুল্কারোপের মাধ্যমে প্রথম পথ বেছে নেওয়া রাজনৈতিকভাবে দুরূহ ছিল। বিগত ১৫ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা বিনিয়োগ বেড়েছে। ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ডলার, ২০১০ সালে তা বেড়ে হয় ১০০ কোটি ডলার এবং ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার সময় আরও বেড়ে ৪৭০ কোটি ডলারে পৌঁছায়। ট্রাম্প আসার পর তৃতীয় পথটিতেও অগ্রগতি ঘটে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রত্যক্ষ মার্কিন উপস্থিতি কমেছে। সে অঞ্চলের জ্বালানিসমৃদ্ধ দেশগুলো যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে বাধ্য হয়েছে এবং সরাসরি গৃহযুদ্ধে অংশ নিয়ে মার্কিন ব্যয়ভার কমিয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় অস্ত্র বিক্রি থেকে মার্কিন আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর সর্বমোট সমরাস্ত্র ক্রয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ভাগে ২২ শতাংশ (২০০৯-১৩) থেকে ২০১৪-১৮ সময়কালে ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়। উল্লেখ্য, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এই ক্রয়ের শীর্ষে ছিল। 

নাগরিকদের তুষ্ট রেখে চীনা বিনিয়োগের সুযোগ প্রশস্ত করার পথটি অতি স্বল্পকালে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় পর্যায়ে ও ব্যবসায়ী মহলে বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তারই সপক্ষে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার ল্যাটিস সেমিকন্ডাক্টর-এ ক্যানিয়ন ব্রিজে চীনা বিনিয়োগ আটকে দেয়। ২০১৮ সালজুড়ে এই বাধা দেওয়ার মাত্রা বৃদ্ধি পায়—মানিগ্রাম, এক্সক্রিয়া, কুয়ালকম, স্কাইব্রিজ ক্যাপিটাল ও জিএনসিতে চীনা বিনিয়োগের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানের পক্ষে পরবর্তী সময়ে জার্মানি ও কানাডার কর্তৃপক্ষ যোগ দেয় এবং কুকা-ল্যেফেল্ড এবং এইকনে চীনা বিনিয়োগে বাধা দেয়। 

আন্তর্জাতিক লেনদেনে ভারসাম্য ফেরানোর বিনিয়োগ-পথ সুগম না হওয়ায় ২০১৮ সাল থেকেই শুল্কযুদ্ধের শুরু। বিশ্বায়নের নামে একসময় পণ্য, প্রযুক্তি ও অর্থের আন্তর্দেশীয় প্রবাহ অবাধ করার মাধ্যমে বহির্বিশ্ব থেকে শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশগুলোতে সম্পদ, অর্থ ও মেধা পাচার হতো। নিজ বলয়ের বাইরে অর্থনৈতিক অগ্রগতির নতুন কেন্দ্র সৃষ্টি হওয়াতে পশ্চিমা শক্তি আজ অবাধ বাণিজ্য রোধের লক্ষ্যে প্রাচীর তৈরি করছে। অথচ দেশজ অর্থনীতির বিনিময় মূল্য সৃষ্টিতে পারস্পরিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় বহু দেশের অর্থনীতিতে শুল্কযুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। চীনও তার ব্যতিক্রম নয়। অবশ্য ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর চীন অধিকতর অন্তর্মুখী এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। তবু চীনের পক্ষে প্রযুক্তি, আর্থিক লেনদেন ও জ্বালানির বিশ্ববাজার থেকে বিযুক্ত হওয়া অসম্ভব। এমনকি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও চীন ও পশ্চিমা বিশ্বের যোগসূত্র গড়ে উঠেছে। সে কারণে ঘটমান শুল্কযুদ্ধকে বাণিজ্যিক কাঠামোতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য করা যায়। অনুমান করা যায়, বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধারক-বাহকদের পক্ষ থেকেই এই উদ্যোগ, এবং তা দেশ, সরকার ও অন্যান্য সংস্থা দ্বারা কার্যকর করা হচ্ছে। সম্ভবত সে কারণেই নতুন আমদানি শুল্ক আরোপের পরক্ষণেই সমঝোতায় পৌঁছানোর তাগিদে বৈঠকে বসার আহ্বান থাকে। দর-কষাকষির মধ্যে দিয়েই হয়তো বড় যুদ্ধ এড়িয়ে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠবে। এমন সম্ভাবনাকে লঘু করে দেখার অবকাশ নেই। 

সমঝোতার বাইরেও দুই শক্তির সম্পর্কে বৈরিতার দিকও রয়েছে, যদিও তার স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন জাগে। বিগত বছরগুলোতে চীন-অবরোধ নীতির আওতায় পশ্চিমা শক্তির নেতৃত্বে সামরিক প্রস্তুতি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে লক্ষ করা গেছে। অতীতে জীবাশ্ম জ্বালানি সম্পদ দখলকে কেন্দ্র করে বৈরিতা হতো। সে কারণে দুর্বল রাষ্ট্র গঠনে মদদ দেওয়া হয়েছে, স্বৈরাচারী শাসকদের সমর্থন দেওয়া হয়েছে, এমনকি শক্তির জোরে যুদ্ধবিগ্রহ ঘটিয়ে লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুহারা করা হয়েছে। তার নমুনা আমরা ঘরের পাশে উন্মোচিত হতে দেখছি। 

২০১৫ সালে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের সিতওয়ে থেকে চীনের কুনমিং অবধি জ্বালানি গ্যাস ও তেলের দুটো পৃথক সরবরাহ পাইপলাইন চালু করা হয়েছে। এর প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল আরও ১৫ বছর আগে। অবশ্য মিয়ানমারে চীনা আধিপত্য খর্ব করে পশ্চিমা শক্তি ও তাদের আঞ্চলিক সহযোগীরা বাংলাদেশ, বঙ্গোপসাগর ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কৌশলগত সামরিক অবস্থান নিতে সচেষ্ট। এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলাটা বোঝার আগেই হয়তো এই ত্রিদেশীয় অঞ্চলের সম্পদ অন্যত্র চলে যাবে। আফগানিস্তান ও মিয়ানমারের খনিজ সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ইসরায়েল, কিছু ইউরোপীয় দেশ ও ভারতীয় পরিচয়ে নানান কোম্পানির সহাবস্থান দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ব্যতিক্রম নয়। 

প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ আজ অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর, তাই এ কাজে পেশাদারি প্রাধান্য পায়। একই সঙ্গে সম্পদ বাজারজাত করা সহজ হয়েছে বলে তা আহরণের কর্তৃত্ব নিয়ে বিধ্বংসী যুদ্ধের আশঙ্কা কমেছে। সার্বিক বিচারে মনে হয়, বৈরিতার ক্ষেত্র পরিবর্তিত হয়ে প্রযুক্তির অঙ্গনে ঢুকছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি তৈরিতে ব্যবহৃত বিরল মৃত্তিকা (রেয়ার আর্থ) যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির চীনা সিদ্ধান্তের পরিবর্তন তারই ইঙ্গিত দেয়। একচ্ছত্র উৎপাদনকারী হওয়ার সুযোগ নিয়ে চীন রপ্তানি কমাতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ নিজ নিজ ভূমিতে বিরল মৃত্তিকা উৎপাদন শুরু করে এবং পুরোনো উৎপাদনক্ষেত্রগুলো চালু করে। ফলে বিশ্ব-উৎপাদনে চীনের অংশ ৮০ শতাংশে নেমে এসেছে। এ ক্ষেত্রে দর-কষাকষি চললেও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পৃথিবীতে প্রবেশের প্রাক্কালে ত্বরান্বিত তথ্যপ্রবাহের প্রযুক্তি (ফাইভ-জি) ও তার অবকাঠামোর ওপর নিয়ন্ত্রণকে ঘিরে মুখ্য বৈরিতা প্রকাশ পাচ্ছে। চীনা বিনিয়োগে পশ্চিমা বাধা তারই প্রকাশ। চীনা কোম্পানির হুয়াওয়ের আশাতীত অগ্রগতি, বিশেষায়িত প্রযুক্তি-অঙ্গনের বনেদি অগ্রজদের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ ও ফাইভ-জি কেন্দ্রিক নতুন ব্যবহারিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন পশ্চিমা শক্তিবলয়কে শঙ্কিত করেছে। এ ক্ষেত্রেও বৈরিতার সঙ্গে সমঝোতার বিভিন্ন উদ্যোগ লক্ষ করা যায়, যা চীন ও পশ্চিমা পুঁজিকে একই ভ্যালু চেইনে আরও গ্রথিত করবে। ভিলফ্রেডো প্যারেটোর এলিট আত্তীকরণের মতো বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হয়তো পুরোনো কিছু সদস্যকে ঝেড়ে ফেলে এবং নতুন যোগ্যদের আত্তীকরণ করে এবারের আপাতসংকট কাটিয়ে স্থিতিতে পৌঁছাবে। তা যত সাময়িকই হোক না কেন। 

আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনকালে বাংলাদেশ বা বাংলা ভাষাভাষী ও অন্যান্য সহ-অবস্থানকারী ক্ষুদ্র-জাতিগোষ্ঠীর শাসকশ্রেণির করণীয় সম্পর্কে উল্লেখ করে এ নিবন্ধের সমাপ্তি টানব। পুরোনো প্রবাদ মনে পড়ে—‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’। এলাকার উভয় শাসক ও প্রজা—ধনী-গরিব, ধর্ম, বর্ণ, ক্ষুদ্র-জাতিগোষ্ঠী, দল ও মতাদর্শনির্বিশেষে ‘উলুখাগড়া’র দলেই পড়ে। তাই সে জাতীয় যুদ্ধের আঁচড় যেন এখানকার মাটি ও মানুষের ওপর না পড়ে, তা নিশ্চিত করা প্রথম করণীয়। নজরদারি প্রয়োজন, তবে সমাজে বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে অতিমাত্রায় নিরাপত্তাভীতি ও স্বৈরচারী বর্জন আবশ্যিক। 

এ অঞ্চলের অ-নবায়নযোগ্য সম্পদ (লুণ্ঠন পর্যায়ে) আহরণের উদ্দেশ্যে ধর্মের নামে বিভিন্ন জাতিসত্তা, অথবা জাতিসত্তার নামে সম-ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। নিজ এলাকায় ব্যবহারের জন্য হোক বা অন্যকে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পদ আহরণের সুযোগ দিয়ে প্রাপ্ত রয়্যালটি স্বদেশে ও জনস্বার্থে ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে হোক, সেসব সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন জরুরি। উল্লেখ্য, মিয়ানমারে দীর্ঘকাল প্রচলিত জাতীয় নিবন্ধনে বাঙালি ও ভারতীয়দের পৃথক জাতিসত্তা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে—মুসলমান-অমুসলমান হিসেবে নয়। আসামের রাজনীতিতে কেউ কেউ ধর্মের কার্ড খেললেও মূলত বাঙালিবিদ্বেষ উসকে দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিলনভূমিতে বিভেদ সৃষ্টির কাজ ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। নিজেদের জাতিসত্তা সমুন্নত করার পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্মানজনক সুসম্পর্ক গড়ে তোলা বঙ্গোপসাগরসংলগ্ন এই এলাকায় বৃহত্তর ঐক্যের জন্য জরুরি। 

বৈরিতা ও সমঝোতার নানা ধাপ পেরিয়ে আমরা যদি নতুন স্থিতিশীল পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারি, তা হবে আরও প্রযুক্তিনির্ভর, যেখানে অনেক দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া এলাকার মানুষকে বিশ্ব অর্থনীতির কর্মকাণ্ড থেকে ছিটকে পড়তে হবে। তাই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় ফাটকা ব্যবসায়ী স্বার্থে চালিত না হয়ে আগামী পৃথিবীর জন্য জাতিকে প্রস্তুত করা প্রয়োজন। এ জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাপদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন জরুরি। সেসবকে কেন্দ্র করে তরুণদের মধ্যে সামাজিক কর্মকাণ্ড জোরদার করার পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে, যেন কথিত নিরাপত্তার নামে বিজ্ঞানচর্চা বা সামাজিক মেলবন্ধন বাধাগ্রস্ত না হয়। 

সাজ্জাদ জহির অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক