নেপথ্য শক্তির দিন ঘনিয়ে এসেছে

ইমরান খান  ও নওয়াজ শরিফ । রয়টার্স ফাইল ছবি।
ইমরান খান ও নওয়াজ শরিফ । রয়টার্স ফাইল ছবি।

এখন অসত্য তথ্য ছড়ানো ও প্রোপাগান্ডার যুগ। পাকিস্তানের শাসনক্ষমতার দাবার বোর্ডে এই দুটি জিনিস বরাবরই ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। কিন্তু সেই প্রোপাগান্ডা এখন একেবারে চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। সরকারের নেপথ্যে থাকা প্রবল ক্ষমতাধর শক্তি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের লড়াইটা ‘ফাইনাল পর্বে’ উঠে আসাই এর আসল কারণ। 

কোনো পক্ষই লড়াইয়ে হারতে চাইছে না। নওয়াজ শরিফ তাঁর নিজের জীবন ও মেয়ে মরিয়ম নওয়াজের ভবিষ্যৎসহ সবকিছু হারানোর ঝুঁকি নিয়ে অটল অবস্থানে আছেন। অন্যদিকে ৭০ বছর ধরে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রাখা সামরিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা এখন হুমকির মুখে পড়েছে। নওয়াজ শরিফ ধীরে ধীরে তাঁর রাজনৈতিক মিত্রদের সহায়তায় এই ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানটিকে অনেকটাই কোণঠাসা করে ফেলেছেন। কেউ ধারণাও করতে পারেননি, নওয়াজকে জেলে পাঠানোর মাত্র ১৪ মাসের মধ্যে নেপথ্য শক্তি পিছু হটতে বাধ্য হবে। এই নেপথ্য শক্তি অস্ত্র ও জাতীয় সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার বলে গোটা দেশের গণমাধ্যমকে হাতের মুঠোয় নিয়ে সেগুলোর মাধ্যমে নিজেদের পক্ষে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি রিয়াদ এবং ওয়াশিংটনও তাদের সহায়তা করছে। কিছুদিন আগেও একজন বিশ্লেষকও অনুমান করতে পারেননি, সৌদি ও মার্কিন আশীর্বাদ পাওয়া শক্তি পরাজিত হতে পারে। তবে কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সাম্প্রতিক আচরণের সমুচিত জবাব দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে পুরো দৃশ্য পাল্টে গেছে। 

ক্ষমতাসীনদের খুব কাছের একটি সূত্র আমাকে নিশ্চিত করেছে, নেপথ্য শক্তির মধ্যে চিড় ধরেছে। সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে থাকা বহু কর্মকর্তা রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের ধারার অবসান ঘটাতে চান। জমিয়তে উলেমায়ে ইসলাম (এফ) পার্টির প্রধান ফজলুর রহমান আগামী মাসে ইসলামাবাদ অভিমুখে ‘লংমার্চ’ এবং সেখানে অবস্থান ধর্মঘট করার যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটি একেবারে কাকতালীয় কিছু তা মনে করার কারণ নেই। ওই সূত্র আমাকে বলেছে, পাকিস্তানের বর্তমান সরকারের কার্যক্রম সেনাবাহিনীর ভেতরের যে অংশটি মেনে নিতে পারছে না, সেই অংশটি ফজলুর রহমানকে সমর্থন দিচ্ছে। কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তান সরকারের নিষ্ক্রিয়তা এবং পাতানো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যর্থতায় এই অংশ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। 

যেহেতু ক্ষমতা কেউই সহজে ছাড়তে চায় না, সেহেতু এই খেলার ফাইনাল রাউন্ড কুৎসিত থেকে কুৎসিততর হচ্ছে। ফজলুর রহমানের লংমার্চে নওয়াজ শরিফের সমর্থকেরা যাতে শামিল না হন, সে জন্য সরকারের নেপথ্য শক্তি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা নওয়াজের সঙ্গে একটি সমঝোতা করতে চাচ্ছে। এই সমঝোতায় ২০২০ সালে নতুন সাধারণ নির্বাচন দেওয়া এবং নওয়াজ ও মরিয়মকে সেই নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলছে তারা। মুসলিম লিগের (নওয়াজ) ভারপ্রাপ্ত প্রধান শাহবাজ শরিফ যাতে কারাগারে থাকা বড় ভাই নওয়াজকে এই সমঝোতা প্রস্তাব মেনে নিতে অনুরোধ করেন, তার জন্য তাঁকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। 

সরকারঘেঁষা কিছু সাংবাদিক ও নেপথ্য শক্তির সমর্থক রাজনীতিক গুজব ছড়াচ্ছেন, ফজলুর রহমানকে সমর্থন না দেওয়ার বিনিময়ে নতুন নির্বাচন দেওয়ার সমঝোতা প্রস্তাবে নওয়াজ শরিফ রাজি হয়েছেন এবং শিগগিরই কন্যা মরিয়মসহ তিনি ছাড়া পেয়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। যেহেতু পাকিস্তানের রাজনীতিতে অপপ্রচার বড় ধরনের ভূমিকা রাখে, সেহেতু সেটিকেই নেপথ্যের ক্ষমতাধরেরা শেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। তবে পিএমএলএন থেকে নির্বাচিত হওয়া সিনেটর মুশাহিদ উল্লাহ খান আমাকে বলেছেন, নওয়াজের যেহেতু এখন হারানোর কিছুই নেই, সেহেতু তিনি কোনো সমঝোতায় যেতে রাজি হবেন না। 

নওয়াজ কারাগারে থাকা অবস্থায় তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন। মৃত্যুর সময় তাঁর পাশে থাকতে পারেননি। তাঁর মেয়ে মরিয়মও এখন কারাগারে। নেপথ্য শক্তি নওয়াজের চরিত্র হনন করেছে। ফলে তাঁর হারানোর কিছু নেই। 

অপরদিকে নেপথ্যে থাকা ক্ষমতাবানেরা সর্বস্ব খোয়ানোর ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থার আরও অবনতি হওয়ায় ইমরান খানকে ক্ষমতায় আনার কী যুক্তি ছিল, সেই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া কাশ্মীরে ভারত যা যা করছে, তার জবাবে পাকিস্তানের কী করা উচিত ছিল, সে প্রশ্নও উঠেছে। এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেপথ্য শক্তির কাছে নেই। অনভিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ১৪ মাস ধরে সরকার পরিচালনায় যত ব্যর্থ প্রমাণিত হচ্ছেন, ততই নওয়াজ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। মরিয়মের সমর্থনে যেসব বিশাল বিশাল জনসভা হয়েছে, তা ইমরান খানকে বিচলিত করেছে। 

এখন কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে ইসলামাবাদে ফজলুর রহমানের কর্মসূচি নেপথ্য শক্তিকে বড় ধরনের চাপে ফেলবে। এই চাপ থেকে তারা বেরিয়ে আসতে চায়। 

মরিয়ম নওয়াজের দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি পিটিশন দায়ের করা হয়েছিল। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন এই পিটিশন খারিজ করে দিয়েছে। তার মানে তিনি কারারুদ্ধ অবস্থায়ই দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারবেন। নেপথ্য শক্তির সমর্থক টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রিকাগুলো বলছে, নওয়াজ শরিফ নেপথ্য শক্তির সমঝোতা প্রস্তাব যে মেনে নিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনের রায়ই তার প্রমাণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো নওয়াজ শরিফ সমঝোতায় রাজি হচ্ছেন না এবং মনে হচ্ছে তিনি সর্বস্ব হারানোর ঝুঁকি নিয়েই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে লড়াইটা জারি রাখবেন। 

ফজলুর রহমানকে নওয়াজ সমর্থন দিন আর না-ই দিন, সেটি এখন আর বড় কথা নয়। একজন কয়েদির কাছে নেপথ্য শক্তি যখন সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে যায়, তখন এটি স্পষ্ট হয় যে চূড়ান্ত পর্বের খেলায় কার জয় হতে যাচ্ছে। 

অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, ১৪ মাস আগে নেপথ্য শক্তি ইমরান খানকে নিয়ে যে খেলা শুরু করেছিল, সে খেলা শিগগিরই শেষ হতে যাচ্ছে। 

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

ইমাদ জাফর: পাকিস্তানের সাংবাদিক ও কলামিস্ট