'আরে বোকা, নিয়ম মেনে চলবি তো ঠকবি'

রাজধানী ঢাকা। ফাইল ছবি
রাজধানী ঢাকা। ফাইল ছবি

এখন শুধু ঢাকায় নয়, বড় শহরগুলোতে তো বটেই, এমনকি উপজেলা বা কোনো কোনো গ্রামেও বহুতল দালান উঠছে। এসব দালানের অনেকগুলোই ভবন নির্মাণ বিধিমালা মানে না। কারণ, ভবনমালিকেরা মনে করেন, এত নিয়মকানুন মানতে গেলে ঠকতে হবে। এতটা বোকা তাঁরা হতে চান না। 

অথচ ভবন নির্মাণ বিধিমালা বা বিল্ডিং কোড প্রযোজ্য। যদিও ২০০৬ সালে এই কোড হয়েছে। তারপর এর ওপর দেশের বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়েছে। এখন মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। গেজেট হবে। ইতিমধ্যে ২৬ বছর চলে গেছে। এত বেশি সময় লাগার কথা নয়। তাও হয়। এটাই যেন আমাদের দেশের রীতি! 

প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে সহযোগিতায় ছিল ইন্টারন্যাশনাল কোড কাউন্সিল, স্মার্ট ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এসডিজি) ও রাজউক। সবাই প্রাণপণে বোঝাচ্ছে বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করলে ভবনমালিক, ভবনে বসবাসকারী এবং আশপাশের মানুষ নিরাপদে থাকতে পারবেন। পরিবেশেরও কোনো ক্ষতি সইতে হবে না। 

কিন্তু ভবনমালিকদের অনেকের মধ্যে সেই সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। তাঁরা ভাবেন, বেশি নিয়মকানুন মানতে গেলে ব্যয় বাড়বে, দরকার কী। তাই কেউ নিয়মের মধ্যে চলতে চাইলে ওঁরা বলেন, ‘আরে বোকা, নিয়ম মেনে চলবি তো ঠকবি!’ 

অথচ দেখুন, রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর কী অবস্থা হয়েছে। প্রায় সাড়ে এগারো শ নিরীহ কর্মী-শ্রমিকের প্রাণ গেল। এখনো এর জের চলছে। অথচ ভবন নির্মাণ ও তার ব্যবহার নীতিমালা মেনে চললে এ বিপর্যয় হতো না। রানা প্লাজার আগেও অনেক ভবন ধসে পড়ে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটেছে। এই তো সেদিন বনানীতে এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে কত মানুষ মারা গেল। বিকল্প সিঁড়িগুলোতে মালপত্র রেখে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। মানুষ নিচে নামতে পারেনি। অথচ বিল্ডিং কোড মেনে চললে এবং নিয়মিত তদারকি থাকলে হয়তো কোনো মানুষকে আগুনে পুড়ে মরতে হতো না। 

বিল্ডিং কোডের মূল কথা হলো এর নকশা সঠিক হতে হবে। কাঠামোগত (স্ট্রাকচারাল) ডিজাইন যথাযথ হতে হবে। যেন ভূমিকম্প হলে সহজে ধসে না পড়ে। আগুন লাগলে মানুষ যেন সহজে বের হয়ে যেতে পারে। ইত্যাদি। অবশ্য সেখানে এটাও দেখা হয় রড-ইট-সিমেন্ট-বালুসহ নির্মাণ উপকরণ সঠিক মানের কি না। ভবন নির্মাণের সময় নির্মাণশ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করার শর্ত রয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, পরিবেশের যেন ক্ষতি না হয়, সেটা নিশ্চিত করার শর্তও রয়েছে। 

তাহলে আমরা বলতে পারি, এই বিধিমালা মেনে চলা তো সাধারণ ব্যাপার। এগুলো মানতেই হবে। যে চালাক, সে জানে এগুলো মেনে চললে তার নিজেরই লাভ। কারণ, ভবনধসে বা আগুনে যে ক্ষতি হয়, তার চেয়ে বরং নিয়মগুলো যথাযথভাবে মেনে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। যারা মানতে চায় না, ওরাই বরং বোকা! তবে এটা শুধু ভবনমালিকদের সচেতনতার ব্যাপারই নয়। যাঁরা তদারক করেন, সেই সরকারি প্রতিষ্ঠান বা তার কর্মীরাও অনেকাংশে দায়ী। নিয়মের ব্যতিক্রম হলে তাঁদেরই তো ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানে ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদেরও সচেতনতা দরকার। 

অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের একটি কথা সেদিনের আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে। ভবন নির্মাণ যথাযথ ডিজাইন অনুযায়ী হয়েছে কি না, তার ছাড়পত্র দেওয়ার নিয়মটি কার্যকর করতে হবে। এখানে সমস্যা হলো অকুপেন্সি সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য ভবন নির্মাণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত যদি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে তাদের ব্যবসা চালানোই অসম্ভব হয়ে পড়বে। কারণ, নির্মাণ চলাকালেই তাদের ফ্ল্যাট বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়। তাই অনেকে প্রস্তাব করেছেন, নির্মাণ চলাকালেই প্রতি ফ্লোরের জন্য সার্টিফিকেট দেওয়ার নিয়ম করা যেতে পারে। তারপরও নিয়মিত তদারকির প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেওয়ার পর আবাসন এলাকায় কোনো ফ্ল্যাটের মালিক যদি নিজের ইচ্ছেমতো বাড়তি একটি ঘর বানান বা ভারী যন্ত্রপাতি বসিয়ে ব্যবসা শুরু করেন, তাহলে তো ভবন ধসে পড়ার বিপদ সৃষ্টি হবে। এগুলো দেখাশোনার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। 

রাজউক বা বাইরের জেলা শহরের পৌরসভা কর্তৃপক্ষের জন্য কাজটি সুষ্ঠুভাবে করা হয়তো সম্ভব নয়। কারণ, ওরা মূলত নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ। তাই সেদিন আমাদের গোলটেবিল বৈঠকে একটি মত এসেছে, যেন তদারকির কাজটি বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, আউটসোর্সিং করা। এই প্রতিষ্ঠানগুলো গঠিত হবে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি থাকতে হবে। 

যাহোক, মূল কথা হলো বিল্ডিং কোড মেনে চলার ওপর সব পক্ষকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে হয়তো আমরা অনেক বিপর্যয় এড়াতে পারব। 

আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক