শিশুদের পিঠে 'বিদ্যাবাড়ি' আর নয়

সেদিন আমার ছেলে ঋদ্ধের জন্মদিন। আমি রাজশাহী থেকে যখন নওগাঁ পৌঁছালাম, ঋদ্ধ তখন স্কুলে চলে গেছে। ক্লাস শেষে ঋদ্ধকে তুলতে স্কুলে গেলাম। সে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। আমি এসেছি ও যেন দেখতে পারে, সে জন্য ক্লাসের জানালার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঋদ্ধের পাশের বন্ধুটি (পরে জানলাম ওর নাম তোহা) আমাকে দেখে সম্ভবত ঋদ্ধকে জানাল। ঋদ্ধ স্বাভাবিকভাবে তাকাল। আমি হাসলেও সে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। বুঝলাম, ক্লাস মুডে আছে, শিক্ষকের ভয়ে আছে। ওর বন্ধু তোহা বোধ হয় ঋদ্ধকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিল এবং ঋদ্ধও তোহার সঙ্গে কথা বলছিল। সেই মুহূর্তে হঠাৎ সামনে থেকে একজন শিক্ষক স্কেল হাতে ত্বরিত বেগে সরবে মারমুখী হয়ে তেড়ে গেলেন ওদের দুজনের দিকে। দেখলাম ওদের ভীতসন্ত্রস্ত আতঙ্কিত মুখ আর বাঁকিয়ে নেওয়া শরীর। মুহূর্তের জন্য আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। যেন শিক্ষকের স্কেলের আঘাত আমার বুকের মাঝখানে এসে আঘাত করল। আমি জানালা থেকে সরে এলাম। ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলে ওকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘বাবা খুব কি লেগেছে?’ ও জবাব দিল, ‘নাহ, বেশি লাগেনি, একটু জ্বলে গেছে, তোহার অনেক জোরে লেগেছে।’ এই ‘নাহ’ যে ‘না’ নয়, সেটি আমি বুঝলাম। আমি জামা তুলে পিঠ দেখতে চাইলাম, কিন্তু ও দেখতে দিল না। বাসায় এসে জামা খুলে দেখলাম ওর পিঠে লাল দাগ হয়ে আছে। জন্মদিনে বাচ্চাটা এভাবে মার খেল, ভেবে সারা সন্ধ্যা ভালো কাটেনি। 

এটি সত্য, আমাদের প্রজন্মের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ শিক্ষকের মার খেয়ে লেখাপড়া শিখেছে। আবার এটিও সত্য, প্রহারের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অনেক শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার ইতিও ঘটেছে। কিন্তু আজকের বাস্তবতা সম্পূর্ণ আলাদা। 

‘মাংস আপনার আর হাড্ডি আমার’—সেই যুগ বাসি হয়েছে। পৃথিবীর সভ্য কোনো দেশে স্কুলে শিশুদের কোনো রকম নির্যাতনের কথা চিন্তাও করা যায় না। এমনকি বাচ্চাদের সঙ্গে উচ্চশব্দে কথা বলাটাও অগ্রহণযোগ্য। উন্নত দেশগুলোতে স্কুলে শিশুদের সঙ্গে শিক্ষক বন্ধুর মতো আচরণ করেন। তাঁরা খেলাধুলা ও আনন্দের সঙ্গে শিক্ষাদান করে থাকেন। এতে শিশুদের যেমন স্কুলভীতি থাকে না, তেমনি তারা লেখাপড়ার প্রতি বেশি মনোযোগী হয়। 

ইউনিসেফ বলছে, শিশুকে মারধর করলে কিংবা তাকে মানসিকভাবে শাস্তি দিলে পরবর্তী সময়ে সেটা তার লেখাপড়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ ব্যাপারে মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, শারীরিক নির্যাতন থেকে শিশুর মনে একধরনের ভয় জন্ম নেয়, যা তার বুদ্ধির বিকাশ ব্যাহত করে এবং স্কুলের প্রতি শিশুটির মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ক্লাসে তারা অমনোযোগী হয়ে পড়ে এবং তাদের শিক্ষালাভ ব্যাহত হয়। 

গবেষকেরা বলছেন, এ ধরনের শারীরিক ও মানসিক শাস্তির প্রভাবে শিশুদের বিভিন্ন চারিত্রিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে, যেমন খাবারের প্রতি অনীহা, অস্থিরতা, অল্পেই রেগে যাওয়া, হীনম্মন্যতা, আত্মবিশ্বাসহীনতা, খিটখিটে মেজাজ প্রভৃতি। 

শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া নিষিদ্ধ করতে ১৯৮৯ সালে ইউনিসেফ ‘কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড’ গ্রহণ করেছে, যে কনভেনশনে বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে স্বাক্ষর করেছে। 

বাংলাদেশে ২০১১ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির নামে শিক্ষার্থী নির্যাতন করা অবৈধ, অসাংবিধানিক, মৌলিক অধিকার পরিপন্থী বলে হাইকোর্ট রায় দেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একই বছরে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি না দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে নীতিমালা জারি করে। 

এ নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীকে মারধর করতে পারবেন না এবং তাদের উদ্দেশে অশালীন মন্তব্য বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি করা যাবে না। এ নীতিমালা লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। 

উল্লেখ্য, রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় কয়েকটি শহরের বিদ্যালয়ে শিশুদের ওপর নির্যাতন প্রায় নেই বললেই চলে। তবে মফস্বল শহর এবং গ্রাম এলাকার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই নীতিমালা মানা হয় না। এর পেছনে রয়েছে অভিভাবক এবং শিক্ষকের ভ্রান্ত ধারণা যে শিশুকে শাস্তি না দিলে সে লেখাপড়া করবে না, শাস্তি পেলেই সে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করবে। অনেক অভিভাবক মনে করেন শিক্ষকের হাতের ‘বিদ্যাবাড়ি’ না খেলে সন্তান মানুষ হবে না। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ শিক্ষক ও অভিভাবকদের মন থেকে ‘গরু পিটিয়ে মানুষ করা’ টাইপের ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টান্তটি উল্লেখযোগ্য। একদিন তিনি একটি স্কুলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ ওনার নজরে এল ক্লাসে অমনোযোগী দেখে জগদানন্দ রায় নামে একজন অঙ্কের শিক্ষক ছাত্রের কাঁধে একটা থাপ্পড় দিয়ে শায়েস্তা করছিলেন। উনি তখনই ভৃত্য ডেকে শিক্ষক জগদানন্দের কাছে চিরকুট পাঠালেন, ‘শুন হে জগদানন্দ দাদা/গাধারে পিটিলে হয় না অশ্ব/অশ্বে পিটিলে হয় যে গাধা’। 

আজকের শিশুরাই আগামী দিনের নাগরিক। এদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে সমৃদ্ধ জাতি আশা করা যায় না। এ জন্য শিশুদের কাছে স্কুল হতে হবে নিরাপদ ও আনন্দময়, যেন তাদের মনে কোনো ধরনের ভীতি বাসা না বাঁধে। তাই কিছুতেই শাস্তি না দিয়ে শিশুদের স্বাভাবিক চঞ্চলতাকে প্রশ্রয় দিয়েই তাকে পড়ালেখায় মনোযোগী করে তোলার পথ বেছে নিতে হবে। 

একটি সাত-আট বছরের শিশুর জন্য দিনে গড়ে প্রায় দিন ঘণ্টা ক্লাস, দুই ঘণ্টা কোচিং ক্লাস এবং দেড় ঘণ্টা প্রাইভেট ক্লাসে মনোযোগ ধরে রাখা অনেকটাই অসাধ্য। শিশুরা কথা বলবেই, মনোযোগ হারাবেই—সে শিক্ষক যতই মারধর বা বকাবকি করুক না কেন। 

শিশুদের আত্মসম্মানে আঘাত করে, এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকুন। ওরা এক একটি ফুল। সুস্থ ও সুন্দর ফুল ছাড়া একটি সুন্দর বাগান কীভাবে বানাবেন। শিক্ষার প্রক্রিয়া হোক আনন্দময়, পরিবেশ হোক নিরাপদ—এই প্রত্যয়ে এগিয়ে যাক বাংলাদেশের সব বিদ্যাপীঠ। 

ড. ফরিদ খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
[email protected]