আওয়ামী শিবিরে হঠাৎ ঝড় ও 'আঙুল চোষা তত্ত্ব'

একনাগাড়ে পৌনে ১১ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ শিবিরে হঠাৎ ঝড় দেখা দিয়েছে। রাজনীতির কুশীলবেরা এ থেকে শিক্ষা নেবেন কি না, সেই প্রশ্নের জবাব এখনই পাওয়া যাবে না। ঝড়ের তাণ্ডবে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা পদ হারিয়েছেন। যুবলীগ নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। যদিও সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তথা সরকারকেই পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’

এত দিন কে কোথায় ছিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। তিনি যঁাদের দিকে আঙুল তুলেছেন, তঁারা যদি তাঁকে প্রশ্ন করেন, তাঁর যুবলীগে এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি হলো কীভাবে? কী জবাব দেবেন?

৫৯ বছর বয়সী যুবনেতা ওমর ফারুক চৌধুরীর বক্তব্য বিশ্লেষণের আগে আমরা ঝড়ের পটভূমিটা জেনে নিতে পারি। সম্প্রতি ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাঁরা দায়িত্ব নিয়েছিলেন গত বছরের ৩১ জুলাই। পৃথিবীতে অনেক অদ্ভুত ঘটনা আছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনের কমিটি গঠন অন্যতম। গত বছরের ১১-১২ মে ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা হয় ৩১ জুলাই এবং পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয় এ বছরের ১৩ মে। আওয়ামী লীগ নিজেকে গতিশীল সংগঠন দাবি করে। এই হলো গতিশীলতার নমুনা। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পাঁচ মাসের মাথায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বিদায় নিতে হলো চাঁদাবাজির অপবাদ মাথায় নিয়ে। ছাত্রলীগের ওই দুই শীর্ষ নেতা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে উন্নয়নকাজের ‘ফেয়ার শেয়ার’ হিসেবে ১৮৬ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে।

ছাত্রলীগের দুই নেতাকে সরিয়ে দেওয়ার পর সরকার যুবলীগের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা এর আগে দলের মনোনয়ন বোর্ডের এক সভায় বলেছিলেন, ‘যুবলীগের একজন নেতা যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে। আরেকজন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলে। সবার আমলনামা আমার কাছে আছে।’

র‌্যাব গত বুধবার ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার এবং তাঁর বাসা থেকে অবৈধ অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি মুদ্রা, মদ ও ইয়াবা উদ্ধার করে। একই দিন র‌্যাব সদস্যরা ফকিরাপুলে অবস্থিত তাঁর মালিকানাধীন ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনোর যন্ত্রপাতি, বিপুল পরিমাণ মদ জব্দ, সেখান থেকে কর্মচারীসহ ১৪২ জনকে গ্রেপ্তার করেন। এরপর তাঁরা ইয়ংমেনসসহ গুলিস্তান, বনানী ও ফকিরাপুলের চারটি ক্যাসিনো (জুয়ার আসর) সিলগালা করে দেন।

গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, ঢাকা শহরে ৬০টির মতো ক্যাসিনো বা জুয়ার আসর আছে, যার বেশির ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে যুবলীগ। খালেদ মাহমুদ নিজে ইয়ংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা চালানোর পাশাপাশি আরও ১৬টি ক্লাবে জুয়ার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। যুবলীগের আরেক নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটও ক্যাসিনো ব্যবসা চালান। র‌্যাব তাঁর বাসায় অভিযান চালালেও তাঁকে ধরতে পারেনি। ঢাকার বাইরে যেসব ক্যাসিনো বা জুয়ার ব্যবসা গড়ে উঠেছে, সেগুলোও আওয়ামী লীগ বা যুবলীগের নেতারা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।

রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও গোলাম রাব্বানী ছাত্রলীগ থেকে বাদ পড়ার পর সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন আল নাহিয়ান খান ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। গত বৃহস্পতিবার দুই ভারপ্রাপ্তর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটি প্রতিনিধিদল গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি বলেন, ‘কোনো নালিশ শুনতে চাই না। ছাত্রলীগের পর যুবলীগ ধরেছি। সমাজের অসংগতি এখন দূর করব। একে একে এসব ধরতে হবে। জানি কঠিন কাজ, কিন্তু আমি করব।’

তবে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্বের সূচনাটি ভালো হয়েছে বলা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী যেদিন ছাত্রলীগ নেতাদের ‘নালিশ শুনতে চাই না’ বলে হুঁশিয়ার করে দিলেন, তার আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারী বাম ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা ছাত্রলীগের হাতে মার খেয়েছেন। আন্দোলনকারীরা ডিনের কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করতে গিয়েছিলেন।

যেদিন র‌্যাব খালেদ মাহমুদের ক্যাসিনোতে অভিযান চালায়, সেদিনই যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী রাজধানীর শাহ আলী থানার গোলারটেক মাঠে শাহ আলী ও দারুসসালাম থানার ৭ থেকে ১১ নম্বর ওয়ার্ডের যৌথ ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনি বলছেন ৬০টি ক্যাসিনো আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আপনারা ৬০ জনে কি এত দিন আঙুল চুষছিলেন? তাহলে যে ৬০ জায়গায় এই ক্যাসিনো, সেই ৬০ জায়গার থানাকে অ্যারেস্ট করা হোক। সেই ৬০ থানার যে র‌্যাব ছিল, তাদের অ্যারেস্ট করা হোক।...অপরাধ করলে শাস্তির ব্যবস্থা হবে। প্রশ্ন হলো, এখন কেন অ্যারেস্ট হবে। অতীতে হলো না কেন, আপনি তো সবই জানতেন। আপনি কি জানতেন না? নাকি সহায়তা দিয়েছিলেন, সে প্রশ্নগুলো আমরা এখন তুলব। আমি অপরাধী, আপনি কী করেছিলেন? আপনি কে, আমাকে আঙুল তুলছেন?’ (প্রথম আলো, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯)

যুবলীগের চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘আমাকে অ্যারেস্ট করবেন? করেন। আমি রাজনীতি করি, ১০০ বার অ্যারেস্ট হব। আমি অন্যায় করেছি, আপনারা কী করেছিলেন? আপনি অ্যারেস্ট করবেন, আমি বসে থাকব না। আপনাকেও অ্যারেস্ট হতে হবে। কারণ, আপনিই প্রশ্রয় দিয়েছেন।’ তাঁর প্রশ্ন ‘এখন হঠাৎ করে কেন জেগে উঠলেন? কারণটা কী? এটা কি বিরাজনীতিকরণের দিকে আসছেন? দলকে পঙ্গু করার কোনো ষড়যন্ত্রে আসছেন? নিষ্ক্রিয় করার ষড়যন্ত্রে আসছেন?’

ওমর ফারুক চৌধুরী মোটেই লজ্জিত হননি তাঁর সংগঠনের নেতার বাসায় ইয়াবা ও অবৈধ অস্ত্র পাওয়ায়। বরং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন এ সময়ে অভিযান চালাল সেই প্রশ্ন করেছেন। তিনি একহাত নিয়েছেন সাংবাদিকদেরও। বলেছেন, পত্রপত্রিকা জানার পর এত দিন লেখেনি কেন? লুকিয়ে রেখেছিল? ওমর ফারুক চৌধুরী যু্বলীগ নেতাদের তালিম দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে পত্রিকার পাতায় চোখ বোলালে দেখতে পেতেন, সাংবাদিকেরা কিছুই লুকিয়ে রাখেননি। ২০১৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রথম আলো রিপোর্ট করেছিল, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ক্লাব প্যাভিলিয়ন ফকিরাপুল, আরামবাগ ক্লাব, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, ডিটিএস ক্লাব, আজাদ বয়েজ ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, বিজি প্রেস স্পোর্টস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া চক্রসহ বিভিন্ন ক্লাবে “ইনডোর গেমস”-এর নামে জুয়া খেলা চলছে।’ অন্যান্য পত্রিকায়ও জুয়া নিয়ে রিপোর্ট হয়েছে। জুয়ার টাকা ভাগ–বাঁটোয়ারা নিয়ে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে।

প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পরই যুবলীগ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে তাদের গঠিত ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের কথা বলা হলো। দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এ রকম ট্রাইব্যুনাল গঠন অভিনব। সংগঠনের কোনো নেতা বা কর্মী গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজ করলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান গঠনতন্ত্রেই আছে। এ জন্য আদালত গঠনের প্রয়োজন নেই। আর সংগঠনের কোনো নেতা-কর্মী ফৌজদারি অপরাধ করলে তাঁর বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই কাজটি করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ওমর ফারুক চৌধুরী যুবলীগের চেয়ারম্যান। তিনি তাঁর কর্মী খালেদ মাহমুদ কিংবা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের কীর্তির কথা জানতেন না, সে কথা কী করে বিশ্বাস করি? তিনিই ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগকে শ্রেষ্ঠ সংগঠন এবং ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে শ্রেষ্ঠ সংগঠক হিসেবে অভিহিত করেছেন। লেখাটি যখন শেষ করে এনেছি, তখনই খবর পেলাম র‌্যাব যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের অফিসে অভিযান চালিয়ে ২০০ কোটি টাকার এফডিআর ও নগদ সোয়া কোটি টাকা উদ্ধার করেছে। প্রধানমন্ত্রী যাঁকে দিনের বেলা অস্ত্র উঁচিয়ে চলার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন, যুবলীগের চেয়ারম্যান তাঁকেই শ্রেষ্ঠ সংগঠক বলে সার্টফিকেট দিচ্ছেন। তাহলে তাঁর আসল চ্যালেঞ্জটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। তবে তাতে শেষ রক্ষা হবে বলে মনে হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুবলীগ চেয়ারম্যানের বিষোদ্গারের ২৪ ঘণ্টা না যেতেই অন্যতম ‘শ্রেষ্ঠ সংগঠক’ খালেদ মাহমুদের বহিষ্কারাদেশে তাঁকে সই দিতে হয়েছে।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]