রাজিয়া বেগম: মা, বন্ধু ও পথপ্রদর্শক

রাজিয়া বেগম
রাজিয়া বেগম

আমার মা রাজিয়া বেগম গত ২৫ আগস্ট ৯৬ বছর বয়সে ইহজগৎ ছেড়ে চলে গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মাকে আমি আম্মু ডাকতাম। আম্মু এক পরিপূর্ণ জীবন যাপন করেছেন। তিনি ছিলেন একাধারে প্রেমময়ী স্ত্রী ও স্নেহময়ী মা। ছয় সন্তানকে নিয়ে তাঁর গর্ব ছিল, কিন্তু তারা যেন বেশি দাম্ভিক না হয়ে যায়, সেদিকে ছিল তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। ১৯৯৬ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন আম্মুকে যখন বললেন, ‘আপনি ছয় সন্তান মানুষ করেছেন, এ তো বড় কাজ।’ আম্মু সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর দিলেন, ‘ওদের বড় করে দিয়েছি, মানুষ করতে পেরেছি কি না জানি না।’

আম্মু ছিলেন দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারপ্রবণ। তাঁর বয়স যখন ষাটের ঊর্ধ্বে, তখন তিনি আমার সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতে হেঁটেছেন। যখন তাঁর বয়স সত্তরের ওপরে, তখন তাঁরই উৎসাহে আমি তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে পল সাইমনের কনসার্ট শুনতে, যেখানে লক্ষাধিক লোক উপস্থিত ছিল। আম্মুর মন ছিল অনুসন্ধিত্সু। সব সময় তিনি নতুন কিছু শিখতে, জানতে উৎসুক ছিলেন। তিনি ৮০ বছর পেরিয়েও নিজেকে ক্রমাগত বিকশিত করতে পেরেছেন। তাঁর নতুন পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা আমাকে আশ্চর্য করত। তিনি ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। তিনি জীবনকে ভালোবাসতেন। শেষ ১০ বছর তিনি হাঁটতে পারতেন না, তখনো দেখেছি হুইলচেয়ারে বসে হয় বাগান করছেন, কিংবা খবরের কাগজ অথবা বই পড়ছেন। দেশ–বিদেশে কী হচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা করতেন এবং তাঁর চারপাশের মানুষের সুখ-দুঃখের খবর রাখতেন। হাসপাতালে চিকিৎসকেরা যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘আপনি আজ কেমন আছেন?’ আম্মু তখন তাঁদের সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, ‘আপনি কেমন আছেন? ভালো আছেন তো?’ তাঁর চিকিৎসকেরা আমাকে বলতেন, ‘আপনার আম্মাই একমাত্র রোগী, যিনি ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কেমন আছেন?”’

নিজের যুগের রীতিনীতি মেনেই আম্মু বড় হয়েছিলেন। তিনি স্কুলে যেতে পারেননি। মাত্র ১৪ বছর বয়সে আব্বুর সঙ্গে বিয়ে হয়, ১৬ বছর বয়সে প্রথম সন্তান জন্ম নেয় এবং তার পরপরই আব্বুর সঙ্গে তিনি তাঁর নোয়াখালীর গ্রাম থেকে পশ্চিমবঙ্গে যান। আমার আব্বু আহমদউল্লাহ, বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের অফিসার ছিলেন এবং ১৯৪৭–এ দেশভাগের আগপর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় চাকরি করেন।

বিয়ের পর প্রথম ১০ বছর যখন আম্মু পশ্চিমবঙ্গে ছিলেন, তখন প্রথম বাংলা সাহিত্যের এবং বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির লোকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। আব্বু-আম্মু দুজনেই বই পড়তে ভালোবাসতেন। বাসায় অসংখ্য বই ছিল। আম্মু বাংলা লেখার ওপর অসাধারণ দক্ষতা লাভ করেন। সে নিদর্শন আমরা পরে দেখতে পাই তাঁর লেখা দুটি বইয়ে। বই দুটি যখন লেখেন, তখন আম্মুর বয়স ৮০ বছর পেরিয়েছে। আমি সব সময়ই ভাবতাম, স্কুলে না গিয়েও আম্মু কেমন করে এত ভালো বাংলা লিখতে শিখলেন!

১৯৭১ সালে আব্বু মারা যাওয়ার পর থেকে আমি আম্মুকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ পেলাম। শুধু মা নয়, বরং ক্রমে আরেকজন নারী হিসেবে আবিষ্কার করলাম।

মা হিসেবে অবশ্যই তিনি ছিলেন অনন্য। ঘরে তাঁর উপস্থিতি ছিল সার্বক্ষণিক। যখন আমরা ঘরের বাইরে যাচ্ছি, তখন তিনি হাসিমুখে দরজায় দাঁড়িয়ে বিদায় দিতেন; যখন ফিরছি, তখনো তিনি হাসিমুখে দরজায়। তাঁর ছয় সন্তানের তিনি ছিলেন প্রথম শিক্ষক। আমরা কেউই কিন্ডারগার্ডেন কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাইনি। আম্মু আমাদের বাসায় ইংরেজি, বাংলা, অঙ্ক শিখিয়েছেন। তারপর আমরা স্কুলে তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। আম্মু প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত সফল: তাঁর ছয় সন্তানের মধ্যে তিনজন হার্ভার্ড, বার্কলে ও আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে এবং অন্য তিনজন শিকাগো, বোস্টন ও ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করে।

আম্মু আমাদের চরিত্র গঠনের শিক্ষা নিয়ে সচেতন ছিলেন। রাগ না করে সাধারণত একটি শ্লোক বা প্রচলিত বাক্য বলতেন, যাতে করে তাঁর মন্তব্য আমাদের মনে গেঁথে যায়। যেহেতু আমি সহজেই রেগে মাঝেমধ্যে কটু কথা বলতাম, তিনি আমাকে প্রায়ই একটা শ্লোক শোনাতেন। তিনি বলতেন, ‘মনে রেখো, মুখের কথা আর হাতের তির, একবার ছুড়লে আর ফেরত আসে না।’ আম্মুকে কাছ থেকে দেখার পর নারীদের সম্পর্কে আমার অনেক ধারণা বদলাতে হয়েছে। ১৯৭৩ সালে নারী সম্পর্কে আমার প্রথম লেখায় এক জায়গায় লিখেছিলাম যে আমাদের দেশের অনেক নারীর কোনো আত্মপরিচিতি নেই, যার প্রমাণ তাদের ডাকা হয় সন্তানদের নামে, নিজের নামে নয়। কিন্তু পরে আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, আমার অবাঙালি বন্ধুরা যখন তাঁকে নাম ধরে ডাকতে চাইতেন, তিনি বলতেন, ‘না, আমাকে তোমরা আম্মু বলে ডাকো।’ তিনি খুশি হয়ে বলে বেড়াতেন, ‘এখন আমি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার আম্মু হয়ে গেছি।’

১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি নিউইয়র্কে আমার বাসায় ছিলেন। তিনি তখন থেকে লিখতে শুরু করেন। প্রথমে ঢাকা ও নিউইয়র্কের পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। তারপর তিনি স্মৃতিকথা লেখেন। তাঁর প্রথম বই স্মৃতির জানালা প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে, তখন তাঁর বয়স ৮০। বইটিতে ছোটবেলা থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবন ও সময়ের বর্ণনা আছে। বইটিকে আমি সামাজিক ইতিহাসের একটি অমূল্য সম্পদ হিসেবে দেখি। তাঁর দ্বিতীয় বই ডাইরীর পাতা থেকে প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। বইটিতে ১৯৭৪ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণের বিশদ বিবরণ আছে।

আম্মু ছিলেন আমার সবচেয়ে বিচক্ষণ সমালোচক। তিনি আমার সব সেমিনার শুনতে যেতেন এবং আমার টক শো দেখতেন। তিনি ঠিকই ধরতে পারতেন কখন আমি সাবলীলভাবে কথা বলতে পারছি না। যখনই তিনি ভাবতেন আমার কাজ বা কথা কারও মনে কষ্ট দিতে পারে, তখনই তিনি বলতেন, ‘মনে রেখো, তুমি চলে গেলে লোকে তোমার ব্যবহারটাই মনে রাখবে।’

এখন আম্মু নেই। আমি ভাবি, কে আমার ভুল-ত্রুটি সব সময় চিহ্নিত করবে? কে মনে করিয়ে দেবে সত্যিকারের মানুষ হতে হলে এখনো আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে?    

রওনক জাহান: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক