জুঁই হালদারের জাপান জয়

অলংকরণ: প্রথম আলাে
অলংকরণ: প্রথম আলাে

বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার পিছিয়ে পড়া গ্রামের একটি হলো মাছমারা। এ গ্রামের খুব সাধারণ পরিবারের মেয়ে জুঁই হালদার (২২)। সম্প্রতি তাঁর ঠিকানা হয়েছে জাপানের রাজধানী টোকিও–সংলগ্ন মাচিদা সিটিতে। এ শহরের বিখ্যাত মাচিদা হাসপাতালে টেকনিক্যাল ইনটার্ন (কেয়ার গিভার) হিসেবে তিনি নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। অসচ্ছল পরিবারের বড় সন্তান, তাই জুঁই স্বপ্ন দেখতেন পড়ালেখা শেষ করে একটি ভালো চাকরি করে পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার। মোংলার সেন্ট পলস হাইস্কুল থেকে এসএসসি, অতঃপর তাঁর প্রয়াত পিসির সাহায্যে ঢাকার হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বিবিএতে ভর্তি হয়েছিলেন খুলনা খানজাহান আলী কলেজে। প্রায়ই জানাতেন তাঁর আর্থিক সংকটের কথা।

দক্ষ অভিবাসী নেওয়ার ক্ষেত্রে ২০১৭ সালের শেষে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে একটি সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। প্রাথমিকভাবে দেশটি জাপানি ভাষাকে প্রাধান্য দিলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং অধীন বিএমইটি ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মন্ত্রণালয় ভবন ও দেশের কয়েকটি টিটিসিতে চার মাস মেয়াদি জাপানি ভাষা প্রশিক্ষণ চালু করে। উত্তীর্ণ ব্যক্তিদের ভিসা, টিকিট ও চাকরির ব্যবস্থা জাপান সরকার করবে—এটা জানার পর জুঁই খুলনা টিটিসিতে প্রশিক্ষণে ভর্তি হন। চার মাস পর প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আইএম জাপানের সহায়তায় জুঁই উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকার বাংলাদেশ–জার্মান কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আসার সুযোগ পান। জাপানি ভাষার গ্রেড এন-৫ পাসের পর তিনি পাস করেন গ্রেড এন-৪। এরপর জুঁইকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২ জুলাই ২০১৯ তিনি রওনা হন জাপানের উদ্দেশে। সঙ্গে আরও সাতজন মেয়ে ও একজন ছেলে।

স্বপ্নের চেয়ে সত্য জীবনের এই অগ্রযাত্রায় জুঁই আত্মহারা। চমৎকার বাসা, খাবার, পোশাক, বাইসাইকেল কিনে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ভাষা তো জানা হলো, কিন্তু কাজ? হাতে–কলমে এত দিন চলেছে কেয়ার গিভিং প্রশিক্ষণ। মন্ত্রণালয়ের সচিব নিজেই গিয়ে দেখে এসেছেন তাঁদের হাসপাতালের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। এরই মধ্যে তাঁরা দুই ভাগে জাপানের দুটি হাসপাতালের কেয়ার বিভাগে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। বেতনও পাচ্ছেন লক্ষাধিক টাকা। জুঁই তাঁর প্রতিক্রিয়ায় জানান, বাড়ির কিছু দেনা পরিশোধ, মায়ের চিকিৎসা এবং দুরন্ত ছোট ভাইটিকে স্কুলে ধরে রাখাই তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য। মাত্র ২২ বছর বয়সে নিজের আর্থিক ক্ষমতায়নে জুঁই নিজেই বিস্মিত।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সাল থেকেই আইএম জাপান (ইন্টারন্যাশনাল ম্যানপাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন) জাপানি ভাষা প্রশিক্ষিত ছেলেমেয়েদের মধ্য থেকে নিজস্ব পরীক্ষক দ্বারা সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা গ্রহণক্রমে প্রার্থী বাছাই শুরু করে। এর ফলে আইএম জাপানের মাধ্যমে সীমিত আকারে প্রথমে ১৬৩ জন এবং জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত ১১৯ জন টেকনিক্যাল ইনটার্ন জাপানে যেতে পেরেছেন। বর্তমানে দেশব্যাপী ২৭টি টিটিসিতে ৪০ জন করে জাপানি ভাষা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো দপ্তরের সুপারিশ বা তদবিরের সুযোগ নেই। বাছাই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত কঠোর। সাম্প্রতিক কালে জাপানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানপ্রধান/টিম বাংলাদেশে এর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ এবং প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য ঘন ঘন বাংলাদেশ সফর করছেন। নিয়োগকারী ব্যক্তি কর্তৃকও সরাসরি প্রার্থী বাছাই হচ্ছে।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জাপান সরকারের মধ্যে গত ২৭ আগস্ট স্বাক্ষরিত সহযোগিতা স্মারক অনুযায়ী জনবল প্রেরণ কেবল টেকনিক্যাল ইনটার্ন পদে সীমাবদ্ধ নেই, বরং ১৪টি খাতে দক্ষ কর্মী পাঠানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ভাষা প্রশিক্ষিত কর্মী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিনা খরচে জাপান যেতে পারবেন। আগ্রহী ২০-৩০ বছর বয়সী এইচএসসি পাস ছেলেমেয়েদের এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। দক্ষ প্রশিক্ষক এবং সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত ভাষা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারে জুঁই হালদারের মতো অসংখ্য ক্ষমতায়িত দক্ষ কর্মী।

বাংলাদেশ ও জাপান সরকার এবং আইএম জাপানের কাছে জুঁই কৃতজ্ঞ। সব পরিস্থিতিতে পাশে থেকে ও সাহস দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে তাঁর পরিবার। এ জন্য মা-বাবা, বৃহত্তর পরিবার ও গ্রামের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।

মাছমারা গ্রামের প্রথম অভিবাসী কর্মী জুঁই। তাঁর শুভানুধ্যায়ী হিসেবে আমাকে অনেক কৃতিত্ব দিলেও আমি নিজে জানি যে তাঁর জন্য আমার কিছুই করতে হয়নি। কেবল প্রশিক্ষণের খবরটুকু নিয়ে এতটা ধৈর্য, সাহস ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রায় দেড় বছর প্রতিযোগিতা চালিয়ে গেছেন এবং শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন। তিনি অন্য ছেলেমেয়েদের জন্য একটি অনুকরণীয় আদর্শ। জুঁই হালদারের জন্য রইল প্রাণঢালা অভিনন্দন।

ড. নমিতা হালদার: প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব