মন্দা, কাশ্মীর এবং এনআরসি

ভারতে এখন নৈরাজ্য অর্থনীতিতে, নৈরাজ্য সমাজে। ছবি: রয়টার্স
ভারতে এখন নৈরাজ্য অর্থনীতিতে, নৈরাজ্য সমাজে। ছবি: রয়টার্স

গাড়ি বিক্রি কমার দায় নতুন প্রজন্মের ঘাড়ে চাপিয়েছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। বেমক্কা দাবি করেছেন, এই একুশ শতকে নতুন চাকরি পাওয়া বা ভালো রোজগার করা ছেলেমেয়েরা আর কিস্তিতে গাড়ি কিনতে আগ্রহী নন; বরং ওলা, উবার বা মেট্রোয় চেপে যাতায়াত করতেই বেশি আগ্রহী। তাহলে বাস, ট্রাকের বিক্রি কমছে কেন? তরুণ প্রজন্ম সেগুলো কিনছে না বলে! 

দ্বিতীয় দফায় ১০০ দিন পার করেছে মোদির সরকার। উত্তর প্রদেশের মথুরায় প্রধানমন্ত্রীর দাবি, তিনি ‘অভূতপূর্ব কাজ’ করেছেন। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা করতে তিনি শুনিয়েছেন গরু-অর্থনীতি, আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডার উদাহরণ। যেখানে সরকার গ্রামবাসীকে গরু দিচ্ছে একটাই শর্তে, প্রথম জন্মানো বাছুরটি নিয়ে নেওয়া হবে, তুলে দেওয়া হবে যার কাছে গরু নেই, তার হাতে। অভিভূত প্রধানমন্ত্রী গত বছর ২০০টি গরু নিয়ে এসেছেন সুদূর রুয়ান্ডা থেকে। 

বেহাল অর্থনীতি আড়াল করতে নেমে হাসির খোরাক হয়েছেন শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল। নিউটনের সঙ্গে গুলিয়েছেন আইনস্টাইনকে। বেমালুম বলে বসেছেন, ‘আইনস্টাইনের মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কারে অঙ্ক কোনো কাজে আসেনি!’ 

ছয় বছরে রেকর্ড পতন। এক ধাক্কায় জিডিপি বৃদ্ধির হার নেমে একেবারে ৫ শতাংশে। 

ভুল, ডাহা ভুল। বৃদ্ধির হার মোটেই ৫ শতাংশ নয়। আসলে ৩ শতাংশ। এটি আসলেই একটি পরিসংখ্যানগত উল্লম্ফন। সোজা বাংলায় গোঁজামিল। ভিত্তিবর্ষ ২০০৪-০৫ থেকে বদলে ২০১১-১২ করে দিতেই দুম করে বাড়তি ২ শতাংশের ধাক্কা। নীতি আয়োগের ভাইস চেয়ারম্যানের অসহায় আর্তনাদ, ‘এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি, গত ৭০ বছরে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি ভারত।’ 

রয়টার্স থেকে রিজার্ভ ব্যাংক। কেউ ভাবেনি। পাঁচ ট্রিলিয়ন বৃদ্ধির লক্ষ্যে অবরোধ। ঋণে জর্জরিত জাতীয় সড়ক নির্মাণ সংস্থা। আপাতত কাজ বন্ধের নির্দেশ। ৮টি বনিয়াদি শিল্পক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার নেমে দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশে। 

এক আর্থিক জরুরি অবস্থা। নিছক কোনো অর্থনৈতিক অধোগতি নয়, ভারত ঢুকে পড়েছে ভয়াবহ মন্দায়। প্রথমত, বাজারে চাহিদার মন্দা। মুখ থুবড়ে পড়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। গ্রামীণ চাহিদা পড়েছে শহরের দ্বিগুণ হারে। দ্বিতীয়ত, বেসরকারি বিনিয়োগে আকাল। তৃতীয়ত, উৎপাদনশিল্পে লক্ষণীয় অধোগতি। চতুর্থত, ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্র, বিশেষ করে গাড়িশিল্পে সংকট। 

পাঁচ টাকার বিস্কুটের প্যাকেটও বিক্রি হচ্ছে না। ১০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে ভারতের বৃহত্তম বিস্কুট প্রস্তুতকারক কোম্পানি পার্লে। বাজারের হাল দেখে উদ্বিগ্ন পার্লের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটানিয়ার ম্যানেজিং ডিরেক্টর। ‘এখন লোকে ৫ টাকার বিস্কুটের প্যাকেট কেনার আগেও দুবার ভাবছে!’ বস্ত্রশিল্পে ভয়ানক মন্থর গতি। সুতার কলে বাড়ছে সুতার মজুত। 

গোড়ায় গলদ। কমজোরি হয়েই চলেছে টাকা। বিশ্ববাজারে ভারতীয় মুদ্রার পতন অব্যাহত। পড়েই চলেছে টাকার দাম। আগস্টের শেষে আবার পতন। ডলারে প্রতি রুপির দাম ৪২ পয়সা কমে ৭২ দশমিক শূন্য ৮।

১০ বছরে এই প্রথম। দুদিনের জন্য উৎপাদন বন্ধ মারুতিতে। টানা ১০ মাস ধরে ভাটা। ভয়ানক মন্দা গাড়ির বাজারে। ব্যাপক হারে কমেছে গাড়ির বিক্রি। ছাঁটাই স্থায়ী-অস্থায়ী বহু কর্মী। মারুতির পর অশোক লেল্যান্ড। আগস্টে ১০ দিনের পর সেপ্টেম্বরের গোড়ায় টানা পাঁচ দিন উৎপাদন বন্ধ অশোক লেল্যান্ডে। নন–ওয়ার্কিং ডে। সংস্থার সেলস রিপোর্ট বলছে, এক বছরে গাড়ির বিক্রি কমেছে ৭০ শতাংশ। নির্মাণ, পরিকাঠামো শিল্পের অবস্থা সুবিধার নয়। এসবের জেরে টান ইস্পাতের চাহিদাতেও। বিভিন্ন প্রকল্পে লগ্নি ছাঁটাই, বিদেশে শাখা বন্ধ করছে টাটা স্টিল। 

এক ধাক্কায় ১০টি সরকারি ব্যাংককে মিশিয়ে করা হচ্ছে ৪টি ব্যাংক। 

বাজারে আগুন। পেঁয়াজ ৫৫ রুপি। আদা ৩৫০ রুপি কেজি। কাঁচা মরিচ ১৫০। সাধারণ মোটা চাল ৩০।

নৈরাজ্য অর্থনীতিতে। নৈরাজ্য সমাজে। অর্থনীতির দুর্দিন আড়াল করতে এক প্রান্তে কাশ্মীর। সেনা-আধা সেনার ঘেরাটোপে বন্দী। যেন এক টুকরা প্যালেস্টাইন। অন্য প্রান্তে আসাম—এনআরসি। ভারত তৈরি করে চলেছে তার নিজের রোহিঙ্গা।

সংসদে চন্দ্রযানের গতিতে ৩০টি বিল পাস। কোনো রকম স্ক্রুটিনি, আলাপ-আলোচনা ছাড়াই। তিন তালাক থেকে ইউএপিএ। জম্মু ও কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা ৩৫-ক ধারা বিলোপ থেকে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) প্রকাশ, শ্রম আইন সংশোধনের পদক্ষেপ। ইউএপিএ মানে, যেখানে দোষীকে নিজেকেই প্রমাণ করতে হবে, সে নির্দোষ। আগে ছিল দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সে নির্দোষ, অভিযুক্ত মাত্র। এখন আপনি ততক্ষণ দোষী, যতক্ষণ আপনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ না করতে পারছেন। ভিন্নমতের যে কাউকে সন্ত্রাসবাদী বলে দেগে দেওয়ার সুযোগ। 

৪০ দিন ধরে অবরুদ্ধ কাশ্মীর। ঘরে বন্দী। বন্ধ মোবাইল নেটওয়ার্ক। ল্যান্ডলাইন। ইন্টারনেট সংযোগ। বন্ধ দোকানপাট। হাটবাজার। এমনকি ওষুধের দোকান পর্যন্ত। সাধারণ মানুষের প্রাথমিক অধিকারটুকু নেই। বড় রাস্তা, জাতীয় সড়কে ব্যারিকেড। নেই কোনো সরকারি পরিবহন। রাজনৈতিক দলের নেতারা হয় গৃহবন্দী, নইলে জেলে। সবে স্কুল খুললেও ছাত্র নেই। প্রতি সাতজনে একজন সেনা-আধা সেনা। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, কাশ্মীর তো ‘ট্রেলার’ মাত্র, ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়’। গোটা সিনেমা এখনো বাকি রয়েছে। আর কী বাকি থাকতে পারে!

এদিকে এক সকালে ‘রাষ্ট্রহীন’ ১৯ লাখ মানুষ। রাজ্যের জনসংখ্যার ৬ শতাংশ। তালিকায় মা–বাবার নাম আছে, শিশুদের নাম নেই। ছেলেদের নাম আছে, বৃদ্ধ মা–বাবার নাম নেই। সাবেক রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্য, বর্তমান–সাবেক বিধায়ক, সেনা-আধা সেনার নাম নেই। কাশ্মীর সীমান্তে পোস্টিং—নাম নেই! মুহূর্তে রাষ্ট্রহীন! পৃথিবীর বৃহত্তম জেলখানা বানাতে ব্যস্ত মোদি! 

আগে ছিল ৪টি ডিটেনশন ক্যাম্প। এখন বেড়ে ১০। তবু জায়গা হচ্ছে না। যাঁদের নাম নেই, তাঁদের যেতে হবে বিদেশি ট্রাইব্যুনালে। হাতে ১২০ দিন। যে ট্রাইব্যুনাল কোনো বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ নয়। যাদের কাজ অনেকটাই চলে প্রশাসনিক ধাঁচে। ন্যায্য প্রক্রিয়া, সুবিচার সুনিশ্চিত করতে জরুরি
বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থাপনা। ডিটেনশন ক্যাম্পে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রাখা বেআইনি। সংবিধানবিরোধী। বন্ধ করতে হবে ডিটেনশন ক্যাম্প। অমিত শাহ, স্মৃতি ইরানি থেকে দিলীপ ঘোষরা বলে চলেছেন, ‘আসামের ধাঁচে এনআরসি হবে পশ্চিমবঙ্গে’। বিজেপি বলছে এনআরসি প্রক্রিয়াকে বাকি ভারতে সম্প্রসারিত করার কথা। যে চেহারাতেই হোক, বাকি ভারতে নয়। বিরোধিতায় সরব বিরোধীরা।

শান্তনু দে কলকাতার সাংবাদিক