ভর্তি নিয়ে অনিয়ম আগেও হয়েছে

>ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই ৩৪ জনের ভর্তি, ক্যাম্পাসে মারধর ও উপাচার্য নিয়োগে বিলম্বের মতো বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান জিয়া রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: ছাত্রলীগের দুটি শীর্ষ পদ থেকে অপসারণের পরপরই ছাত্রলীগের কর্মীরা আন্দোলনকারীদের মারলেন। কীভাবে দেখছেন? 

জিয়া রহমান: এটা তো কমন ঘটনা। দীর্ঘদিন ধরে এমনটাই দেখছি। আলাদাভাবে দেখার অবকাশ পাইনি। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন মাত্রই এটা করছে, তাই আলাদাভাবে বিবেচনা করতে চাই না। আমরা নির্মোহভাবে কোনো কিছুই পর্যালোচনা করি না। যদিও বলেছে তারা করেনি। এখন যদি ধরেও নেন ছাত্রলীগ করেছে; এখানে ছাত্রদল থাকলে তারাও তা–ই করত। এটাই দুর্ভাগ্য, যদিও আমরা তা চাই না। আবার আন্দোলনকারীরাও নির্মোহ অবস্থানে নেই। কারণ, তাঁরা ৩৪ জনের কথা বলছেন, অন্যেরটা বাদ দিয়ে। মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান হোসেন মনসুর, মুশতাক হোসেনরা একইভাবে ভর্তি হয়েছিলেন। ঐকমত্য একটা আছে। ৩৪ জন ছাত্রলীগের? ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্রদলসহ অন্যান্য দলের অনধিক ১০ জন পাওয়া যেতে পারে। এটা একটা ফাঁকি। ঐতিহাসিকভাবে এটা একটা আনহোলি অ্যালায়েন্স (অশুভ আঁতাত)। ক্যাম্পাসে প্রগতিশীলদের একটা স্পেস থাকুক, সেটা আমি চাই। কিন্তু তাঁদের স্ববিরোধী অবস্থান আমাকে হতাশ করে। 

প্রথম আলো: তার মানে আইনি সুযোগ আগে থেকেই ছিল। এমনটা থাকা উচিত? 

জিয়া রহমান: ছিল, অবশ্যই থাকা উচিত নয়। কিন্তু কোনো মহল থেকেই কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেনি। সেখানেই প্রহসন। 

প্রথম আলো: ডিন তাহলে অন্যায্য কিছু করেননি? 

জিয়া রহমান: বিষয়টি ন্যায্য বা অন্যায্যের বিষয় নয়। বিচ্ছিন্নভাবে আপনি যদি বর্তমান উপাচার্য ও ডিনকে দায়ী করেন, সেটা একটা অসম্পূর্ণ বিষয় হবে। কথাটা হলো ভর্তি হলেন ছাত্রলীগসহ অন্যান্য দলের আরও ৬–৭ জন। নাম পড়ল ছাত্রলীগের। আপনি তো খণ্ডিত সত্য প্রকাশ করতে পারেন না। এই বলে আমি কিন্তু বিষয়টির যথার্থতা দিচ্ছি না, মহান করছি না। সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে সত্য যা, তা–ই বলি। আজ যদি ছাত্র ইউনিয়ন বলত তারাও একই কাজ করছে, এটা শোধরাতে হবে, আমি সাধুবাদ দিতাম। আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো চাইলে মন্দের শিকড় উপড়াতে হবে। প্রতিটি ছাত্রসংগঠনের কথাই আমি বলব, একবিংশ শতাব্দীতে এ ধরনের ছাত্রসংগঠনের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। এই সংগঠনগুলো প্রকৃতপক্ষে ছাত্রদের বিষয় নিয়ে কতটা কাজ করছে? 

প্রথম আলো: ডাকসুর ভিপিসহ অনেকের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করছে। আগের সঙ্গে তুলনা করে এখানেও কি বলবেন, ধারাবাহিকতা মাত্র? 

জিয়া রহমান: যদি সত্যি বলি, তা হলো এক দলের একাধিক উপদলের মধ্যে ক্রসফায়ারে যত লোক মারা গেছে—আমি নাম করেই বলছি—সেটা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান কতটুকু গণ-অভ্যুত্থান ছিল? পরে ডাকসুর লোকজন এরশাদের লোক ব্ল্যাক লিস্ট করে যে ফায়দা নিয়েছে, আমরা সবাই সেটা জানি। গণ-অভ্যুত্থান হলে তার তো একটা নৈতিক প্রভাব নেতৃত্বের ওপর পড়ার কথা, সেটা কি পড়েছে? পত্রিকান্তরে জেনেছি, বড় নেতারা কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন। সে জন্যই বলছি, খণ্ডিতভাবে আপনি একটি সময়কে হাইলাইট করে নয়, সামগ্রিকতায় বিচার করতে হবে। আপনার সঙ্গে একমত যে সেরা বিদ্যাপীঠের এক হাজার র‍্যাঙ্কিংয়ের বাইরে আমরা চলে গেছি। আমরা বলি, পুলিশের নাকের ডগায় এটা–ওটা ঘটছে। কিন্তু তারা যে ১৮৬১ সালের আইনে চলে, তেমন ধরনের মূল জায়গায় আমরা আঘাত করি না। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বা ঢেলে সাজানোর কথা আমরা কত দিন বলেছি? হ্যাঁ, বর্তমান শাসনামল ধরে আলোচনা হতেই পারে—

প্রথম আলো: তার মানে ক্যাম্পাসভিত্তিক সন্ত্রাসে ছাত্রদলের মতো ছাত্রলীগ ব্যবহৃত হচ্ছে। 

জিয়া রহমান: আমি হলফ করে বলতে পারি, আমার জানামতে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরাসরি ব্যবহার করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই জায়গায় যায়নি। কোনো সংগঠনের সমস্যা থাকতে পারে। তাদের ক্ষমতার বাহাদুরি আমরা দেখি। অনেক ক্ষেত্রে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রুটি থাকতে পারে, সেই ত্রুটি থাকারও ঐতিহাসিক কারণ আছে। সরকারের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন একটা আঁতাত তৈরি হয়ে গেছে, যেখান থেকে মুক্তির জন্য আমাদের এটা ফোকাস করা দরকার যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা স্বাধীন সামর্থ্য ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে চলবে, সেভাবে তার ক্ষমতায়ন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ, এখানে প্রতিটি ছাত্রসংগঠন তাদের মূল রাজনৈতিক দলের অ্যাজেন্ডা কম–বেশি বাস্তবায়ন করে। তাই জাতীয় রাজনীতির প্রতিফলন কোনো না কোনোভাবে এখানে আছে। 

প্রথম আলো: ওই দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির প্রভাবে শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের অবনতি গত এক দশকে তীব্র হয়েছে কি? এই সময়ে দলীয় বা স্বজনপ্রীতির প্রাধান্যনির্ভর ৯০০ শিক্ষক নিয়োগের তথ্য আমরা জানি। মুক্তি কীভাবে? 

জিয়া রহমান: আমি আমার অন্তর থেকে একদম উল্টো কথা বলি। বাংলাদেশে সবাই তো এখন আওয়ামী লীগের। আসলে রাজনীতি নয়, আঞ্চলিকতা, ধর্ম, প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ইত্যাদি বেশি সক্রিয়। অবশ্য তেমন সব বিবেচনাতেও নিয়োগের শতকরা হার খুবই কম। তবে আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, কাল বিএনপি ক্ষমতায় এলে এদের অর্ধেকের বেশি বিএনপির হবে। এই কেমোফ্লেজটা কিন্তু আছে। তবে শিক্ষক নিয়োগের যে ধারণা বাইরে আছে, আমি সেটা মানতেই রাজি না। মূলত ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ বেশি কাজ করে। যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হবে, তাঁকেই আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগার বানানো হয়; পরে হয়তো বের হয়, তিনি শিবির করতেন। খুবই দুঃখজনক, কিন্তু এ রকম লোকও আছেন, আপনি বুঝতেই পারবেন না তাঁদের আদর্শটা আসলে কী। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের অনেক উপাদান এখানে রয়ে গেছে। আপনার বাড়ি বরিশাল না নোয়াখালী, সেটা দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক বড় ফ্যাক্টর। হল, ক্যানটিন, মসজিদে গিয়ে দেখুন, কোন কোন 

জেলার লোকে ভরা। শিক্ষক হিসেবে আমি লজ্জা পাই, কারণ দুটো প্রথম শ্রেণিধারীকেও শিক্ষক হতে সবার কাছে ঘুরঘুর করতে হয়। 

প্রথম আলো: আপনি শিক্ষক সমিতির দুবারের নির্বাচিত নেতা ছিলেন। ক্যাম্পাসের সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কখনো কথা বলেছেন? 

জিয়া রহমান: সে সুযোগ আমার হয়নি। আপনি যদি 

প্রকৃত শিক্ষক বা শিক্ষকনেতা হন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর সামনে গিয়েও অনেক জোর গলায় কী করা উচিত, 

বলতে পারবেন। তাঁর ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি কিছু মনে করবেন না। 

প্রথম আলো: বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগে বাইরের কাউকে নিয়োগের আশঙ্কা করছেন? 

জিয়া রহমান: সেটা প্রত্যাশিত নয়। ইতিমধ্যে তিনজনের একটি প্যানেল পাঠানো হয়েছে। যিনিই হোন, ওই তিনজনের মধ্য থেকেই উপাচার্য নিয়োগ হওয়া উচিত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমাদের তিয়াত্তরের অধ্যাদেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো আইনই বাইবেল নয়। অবশ্যই সেই আইনের অত্যন্ত ইতিবাচক সংস্কার হওয়া উচিত। 

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ। 

জিয়া রহমান: ধন্যবাদ। 

আরও পড়ুন: