আইন ভঙ্গকারী আটক না শুদ্ধি অভিযান

বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত কয়েকটি কথা হচ্ছে ‘ক্যাসিনো’, ‘শুদ্ধি অভিযান’ এবং ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান’। প্রথমটি অতি সাধারণ বাংলাদেশিদের কাছে অপরিচিত হলেও অন্য দুটি মোটেই অপরিচিত নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে, কখনো কখনো এমনকি বিরোধী দলের কাছ থেকেও, দলের ভেতরে ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালানোর কথা শোনা গেছে। আর ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান’ তো সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের জপমন্ত্রের মতো বিষয়, কে ক্ষমতায় থাকলেন, তাতে এর পার্থক্য ঘটে না। ফলে দুর্নীতি এবং শুদ্ধি অভিযান এমন কোনো বিষয় নয়, যা এই প্রথম শোনা গেল এবং তা শোনামাত্রই মানুষের মনে বিরাজমান অবস্থার অবসান ঘটবে বলে আস্থা তৈরি হবে।

এই দফায় এই কথাগুলো এত ব্যাপক আকারে আলোচনার একটা প্রেক্ষাপট আছে। সেট প্রেক্ষাপটের কারণেই ‘ক্যাসিনো’ কথাটি এখন এই দুইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ১৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে অপসারণের পর ছাত্রলীগের ‘শুদ্ধীকরণের’ কথা আলোচিত হতে শুরু হয়। এই ছাত্রনেতারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে উপাচার্যের কাছে কথিত ৪-৬ শতাংশ ‘কমিশন’, যাকে ওই ছাত্রনেতারা ‘ন্যায্য পাওনা’ বলে বর্ণনা করেছেন, দাবি করেছেন বলে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলাম এ ঘটনা স্বীকারের পর এই কথাটা চালু হয়। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সংসদের বৈঠকে তাঁর দলের কোনো কোনো নেতার আচরণের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেন। 

এই দুই ঘটনাকে একত্র করে গণমাধ্যমে শুদ্ধি অভিযানের সম্ভাবনার কথা প্রচার শুরু হয়। সেই প্রেক্ষাপটে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার মালিকানাধীন একটি ‘ক্যাসিনোতে’ অভিযান চালানো হয় গত বুধবার, তাঁকে আটক করা হয়। গত কয়েক দিনে ঢাকা এবং অন্য কয়েকটি শহরে ক্লাবের নামে কিংবা প্রতিষ্ঠিত ক্লাবের নামফলকের আড়ালে যেসব জায়গায় বেআইনি জুয়া খেলা হতো, সেগুলোর কয়েকটিতে পুলিশ ও র‍্যাবের অভিযান চালানো হয়েছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ, মদ, মাদক, আইনি-বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। 

বলা হচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নতুন শীর্ষ নেতাদের বলেছেন, দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে শুদ্ধি অভিযান প্রসঙ্গে কোনো নালিশ শুনতে চাই না। ছাত্রলীগের পর যুবলীগকে ধরেছি। একে একে সব ধরব। সমাজের অসংগতি দূর করব। জানি এগুলো কঠিন কাজ (যুগান্তর, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে শুদ্ধি অভিযান চলছে। সারা দেশের যেখানেই দুর্নীতি বা অনিয়ম হবে, সেখানেই শুদ্ধি অভিযান চলবে। শুধু যুবলীগ বা ছাত্রলীগের প্রশ্ন নয়, আওয়ামী লীগেরও যাঁরা অনিয়ম-দুর্নীতি করবেন, তাঁদের সবাই একই পরিণতি ভোগ করবেন। 

আওয়ামী লীগে শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে—এমন কথা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরেই অব্যাহতভাবে বলা হয়েছে। ২০১৪ সালের ২ জুন আলোকিত বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়েছিল, ‘আওয়ামী লীগে আসছে শুদ্ধি অভিযান। দল থেকে বাদ পড়ছেন বিতর্কিতরা। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে শাসক দল’ (প্রিয় ডটকম, ২ জুন ২০১৪)। ২০১৬ সালের নভেম্বরে আবারও একই কথা বলা হয়, ‘তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসন করতে নতুন বছরের শুরুতেই মাঠে নামবে দলটি। একই সঙ্গে চলবে শুদ্ধি অভিযানও’ (বাংলা ট্রিবিউন, ১৯ নভেম্বর ২০১৬)। ২০১৮ সালের নির্বাচনের তোড়জোড় শুরুর আগে আবারও একই ধরনের কথাবার্তা শোনা গিয়েছিল। ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকে বারবার একই ধরনের কথাই বলা হয়েছে। 

২০১৪ সাল থেকে দফায় দফায় ‘শুদ্ধি অভিযানের’ কথা বলার কারণ সহজেই বোধগম্য। ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা অসংযত আচরণ, সন্ত্রাস, বেআইনি কার্যকলাপ, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে হেন দুষ্কর্ম নেই, যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েননি। এগুলো দলের জন্য ইতিবাচক হয়নি, কিন্তু এই নিয়ে কালেভদ্রে উষ্মা প্রকাশের চেয়ে বেশি কিছু বলা হয়নি। বিরোধী দলের ওপর চড়াও হওয়া, বিভিন্ন নির্দলীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের শায়েস্তা করার কাজে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ অন্যদের ভূমিকা ক্ষমতাসীনদের সমর্থন ও আনুকূল্য দুই-ই পেয়েছে। ফলে দলের কর্মীরা ওই সব উষ্মাকে লোকদেখানো কাজের চেয়ে বেশি কিছু বলে মনে করেননি। এগুলোরই একটি ধাপ ছিল মাঝেমধ্যে ‘শুদ্ধি অভিযানের’ হুমকি। এসব হুমকিতে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, কথার ফানুস উড়েছে। 

গত কয়েক দিনের ঘটনা এবং এখন যেসব হুমকি দেওয়া হচ্ছে, তা কি আগের চেয়ে ভিন্ন? আপাতদৃষ্টে ভিন্ন। কেননা, ক্ষমতাসীন দল দেখাতে চাইছে এবার তারা কাজে নেমেছে। কিন্তু আসলেই এবার ভিন্ন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় বিভিন্ন কারণে। কেননা, শুদ্ধি অভিযান কথাটি গত ৪৯ বছরে যে দল যখনই বলুক না কেন, তা আত্মোপলব্ধি থেকে, দলের ত্রুটিবিচ্যুতি মেনে নিয়ে, চিহ্নিত করে, সংশোধনের জন্য, আন্তরিকতার সঙ্গে বলেছে—এমন উদাহরণ নেই। আজকে আওয়ামী লীগ যখন দাবি করছে তার দলের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান হচ্ছে, তখনো দলের ভুলত্রুটিগুলো কী, তা নিয়ে আলোচনা নেই। বারবার বলা হচ্ছে দলের ভেতরে পরগাছাদের বিরুদ্ধে এই অভিযান। যার অর্থ হচ্ছে ‘খাঁটি’ আওয়ামী লীগ কর্মীরা এই রোগ থেকে মুক্ত। গত কয়েক বছরে ভয়ভীতি, প্রলোভন দেখিয়ে যাঁদের দলে টেনে নেওয়া হয়েছে, যেন বিরোধী শক্তি না থাকে—এই উদ্দেশ্যে বাছবিচারহীনভাবে দলের আকার বাড়ানো হয়েছে, এখন তাঁদের বিরুদ্ধে বাক্যবিস্তারের নামে ‘শুদ্ধি অভিযান’। কেবল যাঁরা বিভিন্ন বেআইনি ব্যবসায় জড়িত, তাঁদের শায়েস্তা করাকেই দলের শুদ্ধি অভিযান বলে মনে করতে হবে? রাজনীতি বাদ দিয়ে একটি রাজনৈতিক দলে শুদ্ধি অভিযানের কথা বলা হচ্ছে। 

দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেসব ব্যক্তিকে আটক করা হচ্ছে, তাঁদের বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গ করে বেআইনি অর্থ অর্জনের অভিযোগই মুখ্য বলে মনে হয়। তাঁরা কীভাবে এই অবস্থায় এসেছেন, তাঁদের এই অবস্থান কীভাবে তৈরি হয়েছে, কারা তাঁদের মদদ দিয়েছে, কোন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এটি সম্ভব করেছে, কেন সাধারণ মানুষ এই অবস্থা সহ্য করছে, সেই বিষয়ে আলোচনা নেই। আওয়ামী লীগের ভেতরে কেন এই নিয়ে আলোচনা নেই, সেটা বোঝা যায়, কিন্তু গণমাধ্যমে তার অনুপস্থিতি নিশ্চয়ই কিছুর ইঙ্গিত দেয়। এই অভিযান কেন শুদ্ধি অভিযান, কেন নির্ভেজাল বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান নয়, তার মর্মার্থ বোঝা দুরূহ। 

উপরন্তু আটক ব্যক্তিদের অতীতের সাংগঠনিক পরিচয়—তাঁরা কবে কে যুবদল করেছেন, সেই বিষয়ে জোর দেওয়া থেকে মনে হয় যেন যুবদল করার কারণেই তাঁরা সদর্পে এসব অন্যায় করতে সক্ষম হয়েছেন। আসলে গত ১১ বছরে ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্যের বাইরে গিয়ে কারও পক্ষেই এমন সদর্পে জীবনযাপন সম্ভব ছিল না, এখনো নেই। গত এক দশকে বিএনপি এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলোর যে অবস্থা হয়েছে, তাতে করে আটক ব্যক্তিদের কারও কারও যুবদল-সংশ্লিষ্টতার কথা না বললে এই নামে একসময় একটি সংগঠন ছিল, তারাও অপকর্মে যুক্ত ছিল, তাই হয়তো আমাদের মনে হতো না। শুধু তা-ই নয়, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যখন বলেন যে কথিত ক্যাসিনোগুলো বিএনপির আমলে চালু হয়েছে, তখন প্রশ্ন ওঠে তাহলে আওয়ামী লীগ ১১ বছর ক্ষমতায় থেকে কী করেছে? 

কেন, কীভাবে এসব ক্যাসিনো চালু হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা যত হবে ততই একে অপরের দিকে আঙুল তোলার সুযোগ হবে। যুবলীগের চেয়ারম্যান এখন সুর নরম করে অন্যদের হুঁশিয়ার করলেও প্রথম দিন হুংকার দিয়ে বলেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন আগে ব্যবস্থা নেয়নি, কেন গণমাধ্যমগুলো আগে লেখেনি। তাঁর কাছে কি এই প্রশ্ন করা যায় যে তাঁর সংগঠনের বৈধ-অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে লেখার পরিণতি কী হয়, তা কি তিনি জানেন না? এক ক্যাসিনোর মালিকের কেবল টাকার পাহাড় ছিল না, এই ঢাকা শহরেই তাঁর দুটো ‘টর্চার সেল’ ছিল। এই ধরনের টর্চার সেল কেবল তাঁরই ছিল এমন নয়, এখনো আরও কত আছে, কাদের আছে, তার হিসাব তিনি জানেন কি? ভুক্তভোগীরা জানেন। সরকারের বাহিনীগুলো একেবারেই জানে না? এগুলো যে কারণে ও যেভাবে বহাল ছিল ও থাকে, তার বিরুদ্ধে এই কথিত শুদ্ধি অভিযানে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে লক্ষণ দেখা যায়নি। 

অনেকেই আগ বাড়িয়ে একে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান বলেও বর্ণনা করছেন। তাঁরা বিস্মৃত হচ্ছেন যে অপরাধের মাত্রায় এসব ঘটনা বড় হলেও সেগুলো দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের যে ঘটনা ঘটেছে এবং যে ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, তার তুলনায় সামান্যই। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সূচনা ক্যাসিনোর টাকা উদ্ধার দিয়ে করা যায় না, তার জন্য দরকার যাঁরা এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, যাঁরা সেই ব্যবস্থা বহাল রাখছেন, তাঁদের আইনের মুখোমুখি করা, জবাবদিহির রাজনৈতিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। সেই সব প্রশ্নকে আড়াল করে কয়েকজন আইন ভঙ্গকারীকে আটকেই যাঁরা দুর্নীতি দমনের চেষ্টা বলছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ জাগে। 


আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর