শ্রমিক রপ্তানির নামে নারীদের কোথায় পাঠাচ্ছি

মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশের অনেক নারী শ্রমিক লাশ হয়ে ফিরছেন। অনেকে ফিরছেন সর্বস্ব হারিয়ে, সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে। যাঁরা ফিরে আসেননি, তাঁরাও ফেরার পথ পাওয়ার জন্য মাথা কুটে মরছেন। তাঁরা আমাদের বোন, মেয়ে, মা। অথচ কোথাও কোনো উদ্বেগ নেই, কোথাও ক্রোধের প্রকাশ নেই। এর একটা কারণ সম্ভবত এই যে যাঁরা নারী শ্রমিক হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছেন, তাঁদের প্রায় সবাই দরিদ্র শ্রেণিভুক্ত। গরিবের কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও আদতে এঁদের আমরা মানুষ বলে মনে করি না। 

মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কী ব্যবহার করা হয় তার যে বিবরণ পড়েছি, তাতে গা শিউরে ওঠে। ফিলিপাইনের এক মেয়েকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফ্রিজে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার এক মেয়েকে দেশে ফিরিয়ে আনার পরে দেখা গেল, তাঁর শরীরে ২৪টি ছোট-বড় পেরেক ঢোকানো। শ্রীলঙ্কার আরেক নারী শ্রমিকের কথা পড়েছি, যাঁর সৌদি গৃহকর্তা ও তাঁর স্ত্রী মিলে পিটিয়ে আধমরা করার পর চুল কেটে তাঁর মাথার ওপর গরম ইস্তিরি দিয়ে থেঁতলে দেন। 

মধ্যপ্রাচ্যে গার্হস্থ্য শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩২ লাখ, তাঁদের অর্ধেকের বেশি নারী। বাংলাদেশ থেকে গেছেন, এমন নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করে, বিদেশি নারী শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বাংলাদেশিদের। খালেদা আখতারের কথাই ভাবুন। ২৮ বছরের মেয়েটি দেশে ফিরেছেন, সারা গায়ে ব্যান্ডেজ জড়ানো। যে বাসায় তিনি কাজ করতেন, সেই গৃহকর্তা তাঁকে দু-দুবার পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন। পরে বাংলাদেশ সরকারের ব্যবস্থাপনায় ‘নিরাপদ গৃহে’ আশ্রয় পেলে তিনি জানে বেঁচে যান। আসিয়া বেগম নামের আরেক নারী শ্রমিক জানিয়েছেন, চার মাস তিনি উপসাগরের একটি দেশে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। এই চার মাসে এক পয়সাও বেতন পাননি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আসমা নামের একটি মেয়ের কথা বলেছে, অসহ্য হয়ে তিনি দেশে ফিরে যেতে চাইলে তাঁর রিক্রুটিং এজেন্ট তাঁকে বেত দিয়ে ৫০ বার আঘাত করে। 

নিজের নাম প্রকাশ করতে সাহস হয়নি, এমন এক নারী ‘মিডল ইস্ট আই’ নামের একটি সংস্থাকে জানিয়েছেন, গার্হস্থ্য কর্মী হিসেবে চাকরি পেলেও তাঁকে কার্যত পালাক্রমে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। গর্ভবতী হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। কয়েক বছর আগে কুড়িগ্রামের একটি মেয়ের কাহিনি নিউইয়র্ক টাইমস-এ ছাপা হলে তা নিয়ে হালকা কথাবার্তা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু এরপরও মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ হয়নি। এই সব নারী শ্রমিকের অবস্থা এতই খারাপ যে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো নির্যাতিত মেয়েদের সাময়িক আশ্রয় দিতে ‘নিরাপদ গৃহের’ ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছে। নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন বন্ধের জন্য আইনকানুনের কিন্তু কমতি নেই। জাতিসংঘের শ্রম সংস্থা বলেছে, আইন আছে, কিন্তু সে আইন বাস্তবায়নের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। করে কী হবে। আইন যাঁরা বানান, তাঁরাই তো এই সব নির্যাতনের হোতা। অন্য কারণ, পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে কোনো কথাবার্তা নেই। সব পত্রপত্রিকা, রেডিও, টিভিও সেই সব বাদশাহজাদার দখলে। 

নারী শ্রমিকদের প্রতি আরবদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, তার একটি উদাহরণ দিই। কিছুদিন আগে আন্দোস আলকাত্তান নামের কুয়েতের এক নারী ব্লগার মেয়েদের সৌন্দর্যের ওপর লেখালেখি করে জনপ্রিয় হয়েছেন। তিনি লিখেছেন, যেসব মেয়ে গৃহকর্মের কাজ নেন, তাঁদের কোনো ছুটি থাকাটা ন্যায্য দাবি নয়। তাঁদের যে পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়, সেটাও ঠিক। কুয়েত কিছুদিন আগে গৃহকর্মীদের পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার নিয়ম চালু করায় তার প্রতিবাদে আলকাত্তানের এই মহান বাণী। কোনো কোনো দেশ, যেমন ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক পাঠানো কমিয়ে দিয়েছে। ফিলিপাইনের এক নারী শ্রমিককে ফাঁসি দেওয়ার ঘটনার পর সে দেশের সরকার নারী শ্রমিক রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এ রকম কঠোর অবস্থান নেওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও কিছুটা নমনীয় হয়েছে, তাদের সঙ্গে নতুন করে চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে। 

আমাদের সরকারও যে এ নিয়ে কিছু করছে না, তা নয়। ২০১৬ সালে লন্ডনে বাংলাদেশের উদ্যোগে অভিবাসনের ওপর একটি ‘গ্লোবাল ফোরাম’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নারী শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণের প্রশ্ন সেখানে আলোচিত হয়েছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, নারী শ্রমিকের অধিকার রক্ষার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলোর ওপর চাপ প্রদানের বদলে কীভাবে আরও বেশি সংখ্যক শ্রমিক রপ্তানি করা যায়, তা নিয়ে দেনদরবার করতেই আমাদের আগ্রহ বেশি। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। শ্রমিক, তা নারী বা পুরুষ—সবই তো আমাদের জন্য সোনার ডিম পাড়া হাঁস। তাঁদের রক্ত ও ঘামের অর্থ দিয়েই না আমরা দেশে ফুটানি করি। ফলে এই হাঁসের গলা টিপে ধরব, তা কী করে হয়! 

কিছুদিন আগে জার্মান রেডিওতে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব যে কথা বলেছেন, তাতে মনে হলো আসল দোষ এই সব নারী শ্রমিকেরই। বড্ড বেশি কথা বলেন তাঁরা। তিনি বললেন, সৌদি আরবে যেসব নারী শ্রমিক আছেন, তাঁদের ৮০ শতাংশ নিরাপদে আছেন, সমস্যা কেবল ২০ শতাংশ নিয়ে। ২০ শতাংশ মানে প্রায় ৫০ হাজার নারী শ্রমিক। আমলার বক্তব্য যদি আমি বুঝে থাকি তো তার অর্থ, মাত্র ৫০ হাজার নারী, তাঁদের নিয়ে অত চিন্তার কী আছে! অধিকাংশই তো ভালো আছে। এক হিসাবে দেখছি, ২০১৮ সালে কমপক্ষে ১ হাজার নারী শ্রমিক শরীরে আঘাতের চিহ্ন নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। গত আড়াই বছরে উপায় খুঁজে না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন, এমন নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৫০ জন। অথচ সচিব মহোদয়া দাবি করেছেন, যাঁরা সরকারি সেফ হোমে আছেন, তাঁদের শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ মিথ্যা। প্রশ্ন হলো, যদি সব অভিযোগ মিথ্যা হয়, তাহলে এই সব সেফ হোম বানিয়ে রাখার প্রয়োজনটা কী? 

সচিব মহোদয়া আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, যেসব নারী সৌদি আরবে যাচ্ছেন, তাঁদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই, আরবি জ্ঞান নেই। সমস্যার সেটি একটি বড় কারণ। খুব খাঁটি কথা, কিন্তু তাঁরা প্রশিক্ষিত নয় জেনেও কেন তাঁদের বিদেশে পাঠানো হচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। 

সত্যি কথাটা হলো চাপ না থাকলে শ্রমিকদের কথা কোনো সরকারই ভাবে না। পোশাক কারখানার শ্রমিকদের কথা ভাবুন। এই খাতের শ্রমিকদের অবস্থা কিছুটা যে উন্নত হয়েছে, তার কারণ পোশাকশিল্পের ও বিদেশি আমদানিকারকদের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ। দেশের ভেতরেও শ্রমিক ইউনিয়নগুলো মালিক পক্ষ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সংগঠিত হতে চেষ্টা করছে। 

ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কায় বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই গার্হস্থ্য শ্রমিকেরা সংগঠিত হতে শুরু করেছেন। এসব দেশে সরকার যে নড়েচড়ে বসেছে, তার একটা বড় কারণ এই সব শ্রমিক সংগঠনের কর্মতৎপরতা। বাংলাদেশে ও বিদেশে কর্মরত নারী শ্রমিকদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবে তাঁদের গলার আওয়াজ এখনো বড্ড ক্ষীণ। নখেও তেমন ধার নেই। অবস্থা বদলাবে, যদি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটি ব্যাপকভিত্তিক মানবাধিকার কোয়ালিশন গঠন করা সম্ভব হয়। 

সেসব কবে হবে জানি না, তবে যে কাজটা আমরা পত্রপত্রিকার লোকেরা করতে পারি তা হলো মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকদের দুর্ভাগ্যের কথাটা কিছুটা গুরুত্বের সঙ্গে সামনে তুলে ধরা। কত নারী শ্রমিক ফিরে আসছেন, সে খবর ছাপা হচ্ছে বটে, কিন্তু পরিসংখ্যান তুলে ধরা ঠিক সমস্যার ওপর আলো ফেলা নয়। এই নারীরা কেবল পরিসংখ্যান নন, তাঁদের নাম-পরিচয় রয়েছে। কেন ও কীভাবে তাঁরা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছিলেন, কেনই-বা ফিরে এলেন, সেই কথা তালাশ করে দেখা দরকার। দরকার একটু মানবিক সহানুভূতির। 

হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি