সংখ্যালঘুদের বঞ্চনার ৪৭ বছর

৪ জুন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, এএলআরডিসহ কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে সিরডাপ মিলনায়তনে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়, যাতে সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে সাংসদ, বিভিন্ন দলের নেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও যোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের সমস্যা নিয়ে কিছু গৎবাঁধা কথা বলেছেন। সরকার সংখ্যালঘুদের হূত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।

কিন্তু সেই আশ্বাস যে ভুক্তভোগী হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারেনি, তা বোঝা গেল অর্পিত আইনের শিকার কয়েকজন রিক্ত-নিঃস্ব মানুষের কথায়। তাঁরা বলেছেন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন হলেও বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেই। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, এ আইনের অধীনে ৭৪ হাজার মামলা হয়েছে। মামলা দায়ের করার সময়সীমা ৩০ জুন থেকে আরও তিন মাস বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তি কবে হবে, কীভাবে হবে, সে ব্যাপারে নির্দেশনা নেই। বড় সমস্যা হলো, ভূমি প্রশাসন ও তহশিল অফিসের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী এই মামলা নিয়ে উৎকোচ-বাণিজ্য শুরু করেছেন। কয়েকজন ভুক্তভোগী নিজেদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছেন। জানি না, তাঁদের এই কান্না বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও তার কর্ণধারেরা শুনতে পাচ্ছেন কি না।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রকে আমরা নাকচ করে দিলেও শত্রু সম্পত্তি নামের কালো আইনটি বাতিল করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ, যার মৌলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও সেই আইন কেবল হিন্দু নয়, অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের গলার কাঁটা হয়ে আছে।

সেদিনের আলোচনা সভায় ভুক্তভোগী হিন্দু সম্প্রদায়ের বন্ধুরা বর্ণনা করছিলেন কীভাবে তাঁদের সম্পত্তি দখল হয়ে গেছে। এখনো হচ্ছে। কীভাবে তাঁরা বাপ-দাদার সম্পত্তি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। পাকিস্তান আমলের সেই চরম বৈরী পরিবেশে হয়তো এক ভাই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, সে জন্য অন্য ভাইকে বা ভাইদের এখনো কাফফারা দিতে হচ্ছে; এক ভাইয়ের কারণে সবার সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হয়ে গেছে।

যে প্রশ্নটির উত্তর মেলে না, তা হলো স্বাধীনতার পর তৎকালীন সরকার কেন এই কালো আইন ভিন্ন নামে রেখে দিয়েছিল। একাত্তরের আগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যেসব সদস্য দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তাঁরা পাকিস্তানের চোখে শত্রু হতে পারেন; বাংলাদেশের চোখে শত্রু হলেন কীভাবে? মনে রাখা প্রয়োজন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর প্রথম আঘাতটি এসেছিল এই সংখ্যালঘুদের ওপরই।

১৯৭২ সালের ২৯ নম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশে শত্রু সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি করা হয়। এরপর ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চ জাতীয় সংসদে Enemy Property (Continuance of Emergency Provions) (Repeal) Act, 1974 (ACXLVOT 1974) আইনটি জারি হয়। সে ক্ষেত্রে এই তারিখের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো সম্পত্তি অর্পিত হওয়ার সুযোগ নেই। আরতি রানী দাশ বনাম সুদর্শন কুমার পাল এবং অন্যান্য মামলায় (৫৬ ডিএলআর ৭৩ এডি) সুপ্রিম কোর্ট এই মত পোষণ করেন যে ‘শত্রু সম্পত্তি আইন Continuance No. 1 of 1969 রহিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে আপনাআপনি বাতিল হয়ে গেছে এবং ২৩-০৩-১৯৭৪ তারিখের পর থেকে নতুন কোনো সম্পত্তি অর্পিত হিসেবে গণ্য করা যাবে না ওই আইনের আলোকে, যা ইতিমধ্যে মৃত।’

কিন্তু উচ্চ আদালতের এই নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সেই মৃত আইন প্রয়োগ করেই পূর্বাপর সব সরকারের আমলেই হিন্দু সম্প্রদায়ের নতুন নতুন সম্পত্তি অর্পিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের যে পরিমাণ সম্পত্তি অর্পিত হিসেবে তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে, তার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চের পরের। অর্থাৎ সরকারের তালিকায় বর্তমানে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে যা আছে, তা আসলে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরীহ ও দুর্বল মানুষের কাছ থেকে দখল করা। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রাজনীতি ও প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় এই অপকর্ম করেছেন। রাষ্ট্র ও সরকার কখনোই তাতে বাধা দেয়নি। দুর্বলের পাশে দাঁড়ায়নি।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখল করার মতো বেআইনি ও অমানবিক কাজটি যাঁরা করেছেন, তাঁরা এই সমাজেরই মানুষ। তাঁদের কেউ রাজনীতিক, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ আইনজীবী, কেউ সরকারি কর্মকর্তা। আমরা জানতে পেরেছি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের শহীদ জি সি দেবের পৈতৃক বাড়িটিও অর্পিত হয়ে গেছে, এমনকি ঢাকার ধানমন্ডিতে তিনি যে বাড়িটি করেছিলেন, সেটি নানা কারসাজিতে দখল করে নিয়েছে কুচক্রীরা। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম প্রস্তাব উপস্থাপনকারী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটিও অর্পিত সম্পত্তি হয়ে গেছে। এই অন্যায় কীভাবে মেনে নেওয়া যায়?

সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আশা করছে না যে বিএনপি-জামায়াত বা জাতীয় পার্টির সরকার তাদের অর্পিত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবে। রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে তারা সাম্প্রদায়িকতাকে তোষণ করে। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে তো সেই বেদখল হয়ে যাওয়া সম্পত্তি তারা ফেরত পাওয়ার দাবি করতে পারে। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ নামে একটি আইন সংসদে পাস করলেও তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ, যার কারণে সেই আইনের ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তী পাঁচ বছর এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য ছিল দুর্যোগকাল। ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রধান ও প্রথম শিকারও হয় হিন্দু সম্প্রদায়। পুরোনো সম্পত্তি ফিরে পাওয়া দূরে থাক, তখন তাদের এ দেশে বসবাসই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হিন্দু সম্প্রদায় ২০০১ সালের আইনটি সংশোধনের দাবি জানায়; অনেক দেনদরবার ও আন্দোলন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ সালে আইনটির  তিন দফা সংশোধন করা হয়; কিন্তু এখন পর্যন্ত পরিপত্র জারি করা হয়নি। তাহলে কি সরকারের ভেতরেই একটি চক্র লুকিয়ে অছে, যারা চায় না হিন্দু সম্প্রদায় তাদের হারানো সম্পত্তি ফিরে পাক?

আলোচনা সভায় অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কতগুলো জরুরি সুপরিশ পেশ করা হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

ক. অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ২০০১-এর ধারা ২(খ) এবং ৯(১) অনুসারে প্রকাশিত ‘খ’ তফসিল পুরোটা বাতিল করতে হবে।

খ. উচ্চতর আদালতের রায় অমান্য করে ২৩-৩-১৯৭৪-এর পরে যেসব সম্পত্তি ‘ক’ তফসিলভুক্ত গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তা বাতিল এবং ওই তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।

গ. অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ (সংশোধন) আইন, ২০০১-এর ধারা ৯(৬) লঙ্ঘন করে প্রকাশিত ‘ক’ ও ‘খ’ তফসিলের সংশোধিত তালিকা প্রকাশের নামে নতুন করে যেসব সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, সেসব সম্পত্তির তালিকা অবৈধ ও নিয়মবহির্ভূত ঘোষণা করে বাদ দিতে হবে।

ঘ. ভুক্তভোগীরা যাতে সব কাগজপত্র সংগ্রহ করে সঠিকভাবে ট্রাইব্যুনালে বা জেলা কমিটিতে আবেদন করতে পারেন, তার জন্য আবেদনের সময়সীমা আরও ৩০০ দিন বাড়াতে হবে এবং ভূমি প্রশাসনের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ভুক্তভোগীদেরও দ্রুত বৈধ সহযোগিতা প্রদানের নির্দেশ জারি করতে হবে।

ঙ. আগে যাঁরা কোনো দেওয়ানি আদালত থেকে সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার জন্য ডিক্রি পেয়েছেন, এ আইনের ১৩ ধারা তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না—এই বিধানটি সংযুক্ত করতে হবে।

চ. অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণসংক্রান্ত জেলা কমিটি এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র জারি করতে হবে।

এখন দেখা যাক কারা হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি অর্পিত করার নামে দখল করেছেন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বঞ্চনা: অর্পিত সম্পত্তির সাথে বসবাস গ্রন্থের ভূমিকায় ড. আবুল বারকাত লিখেছেন, ‘এ আইন সম্পূর্ণভাবে সংবিধানপরিপন্থী, মানবতা এবং সভ্যতাবিরোধী। এ আইন সাম্প্রদায়িকতাকে ইন্ধন জুগিয়েছে এবং মানবতাবিরোধী এ আইনের কারণে হিন্দু সম্প্রদায় তাদের জমি থেকে অধিকার হারিয়েছে, বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়েছে, তাদের পারিবারিক বাঁধন ভেঙে গেছে, অন্তর্নিহিত মানবিক সম্ভাবনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং একটি স্বার্থান্বেষী মহলের উদ্ভব ঘটেছে।’ (প্রকাশক: পাঠক সমাবেশ ২০০৯)

সেই স্বার্থান্বেষী মহলের পরিচয়ও খুঁজে বের করেছে বইটি: ‘অতীতে অর্পিত সম্পত্তি দখলের সময় সর্বোচ্চসংখ্যক ৩৭ শতাংশ সুবিধাভোগী মুসলিম লিগের সঙ্গে জড়িত ছিল। আর বর্তমানে (২০০৬) ক্ষমতাসীন বিএনপির সঙ্গে ৪৫ শতাংশ, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ৩১ শতাংশ, জামায়াতের সঙ্গে ৮ শতাংশ ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে ৬ শতাংশ সুবিধাভোগী সংশ্লিষ্ট। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপির সঙ্গে সুবিধাভোগীদের ৭২ শতাংশ সংশ্লিষ্ট ছিল। ওই সময়ে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। ১৯৯৫ সালে সুবিধাভোগীদের বেশির ভাগই দলবদল করে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। আবার ১৯৯৭ সালে সুবিধাভোগীদের বেশির ভাগই ২০০৩ সালে ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেয়।’ (পৃষ্ঠা ৯৪)

তাহলে দেখা যাচ্ছে, এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায় কেবল পাকিস্তান আমলে প্রণীত কালো আইনের শিকার নয়; রাষ্ট্রের ও জনগণের সেবায় নিয়োজিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতাদের লোভের কাছেও চরম অসহায়। এ কারণে পৈতৃক বাস্তুভিটা ও সহায়সম্পত্তি হারিয়ে এখন নিজ দেশে পরবাসী হয়ে আছে তারা।

l সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।