ক্যাসিনো: ক্লাবগুলোর কথা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখ

বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন ও অলঙ্ঘনীয় দলিল। রাষ্ট্রযন্ত্র যাঁরা চালান, তাঁরা উচ্চশিক্ষিত, অনেক ভারী ভারী বই পড়েছেন, কিন্তু এই যে ছোট বইটি তাঁরা মন দিয়েছেন পড়েছেন কি না কে জানে। সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়া খেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ আর আছে: ‘[রোগ] ‘আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’

সংবিধানে এ ধারা রাখার পেছনে একটি পটভূমি রয়েছে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু পতিতাবৃত্তি ও জুয়া খেলা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হতো, ‘মদ, গাঁজা, ভাং, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি আইন করিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করিতে হইবে।’ চুয়ান্ন ও সত্তরের নির্বাচনেও এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটেই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে এই বিধান যুক্ত করা হয়।

সুদূর অতীত থেকে চলে আসা পতিতাবৃত্তি ব্রিটিশ আমলে এ উপমহাদেশের সমাজে বিস্তার লাভ করে। ইসলাম ধর্মে মদ, জুয়া হারাম। ইসলামি রিপাবলিক পাকিস্তান ছিল ‘পবিত্র ভূমি’, কিন্তু সেখানে ব্রিটিশ আমলের পতিতাবৃত্তি যথাপূর্ব থেকে যায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ভোগবাদী মনোবৃত্তি থেকে দেহব্যবসা টিকে থাকে। জুয়া, মদ ও দেহব্যবসা পরস্পর সম্পর্কিত। নষ্ট পুঁজিবাদী সমাজের এটা বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রণেতারা সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি ‘সমাজতন্ত্র’ সন্নিবিষ্ট করায় মাদক ও জুয়াকে নিষিদ্ধ করেন।

অখণ্ড বাংলায় ঢাকা ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর নগরী, যদিও বয়সে ঢাকা অনেক পুরোনো কলকাতার চেয়ে। ইংরেজরা কলকাতাকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী করায় ঢাকা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলার শিকার হয় এই প্রাচীন মোগল নগরী। কৃষিপ্রধান পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) গরিব প্রজাদের খাজনার টাকায় গড়ে ওঠে অত্যাধুনিক কলকাতা মহানগরী। কৃষি, তাঁতশিল্প প্রভৃতি থেকে বাংলার রাজস্বের ১২ আনা সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলার জনগণের। কিন্তু সেই রাজস্বের ১২ আনা ব্যয় হতো কলকাতার উন্নয়নে। তাতে পূর্ব বাংলা হয়ে পড়ে অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র। তা সত্ত্বেও উনিশ শতক থেকে খেলাধুলায় ঢাকা ছিল উপমহাদেশে অগ্রসর।

ঢাকার তিন নবাব আবদুল গনি, নবাব আহসানউল্লাহ এবং নবাব স্যার সলিমুল্লাহ খেলাধুলা ও শরীরচর্চার উন্নয়নে অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকায় বহু স্পোর্টস ক্লাব ও শরীরচর্চা কেন্দ্র। তা থেকে বের হন বহু খ্যাতিমান খেলোয়াড়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ঢাকার খেলাধুলার ক্ষেত্রে যোগ হয় নতুন মাত্রা। উপমহাদেশের আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ঢাকা বহুবার কলকাতাসহ উপমহাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরাজিত করেছে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা পূর্ব বাংলার রাজধানী হলে মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারার্স, ওয়ারীসহ স্পোর্টস ক্লাবগুলো নতুন উদ্দীপনায় যাত্রা শুরু করে। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, টেনিস, ভলিবল প্রভৃতি খেলায় বাঙালি কৃতিত্বের পরিচয় দেয়। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে প্রতিযোগিতায় বেঁটেখাটো ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি বাঙালি খেলোয়াড়েরা পশ্চিম পাকিস্তানের ৬ ফুট লম্বা–চওড়া খেলোয়াড়দের ধরাশায়ী করেন শুধু নৈপুণ্যের কারণে—শরীর দিয়ে নয়। এই নৈপুণ্যের পেছনে ছিল স্পোর্টস ক্লাবগুলোর কর্মকর্তাদের বিরাট ভূমিকা।

১৯৫২ সালের মাঝামাঝি আমি ঢাকায় এসেছি। দেখেছি স্পোর্টস ক্লাবগুলোর কী মর্যাদা। এগুলোর কর্মকর্তাদের মানুষ অত্যন্ত সমীহ করত। ক্রীড়ামোদী উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা অফিসের পর ক্লাবগুলোতে আসতেন। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান, পুলিশের আইজি আবদুল খালেক, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে মেসবাহউদ্দিন আহমদ, মাইনুল ইসলাম (ঢাকা পৌরসভার প্রশাসক, পরে পূর্তসচিব), মোহাম্মদ আমিন, প্রকৌশলী আজহারউদ্দিন, গাজী গোলাম মোস্তফা, পুলিশ কর্মকর্তা রকিব খোন্দকার প্রমুখ ষাটের দশকে এবং স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সময় স্পোর্টস ক্লাবগুলোতে যাতায়াত করতেন। তাঁরা বৈকালিক আড্ডায় খেলাধুলায় উন্নতির জন্য যে শুধু আলোচনা করতেন তা-ই নয়, দেশের সমস্যা নিয়েও আলোচনা করতেন।

খেলাধুলার উন্নয়নে সেকালের অবাঙালি কোনো কোনো কর্মকর্তার ভূমিকাও স্মরণীয়। ঢাকা স্টেডিয়ামসহ অনেক স্থাপনা প্রতিষ্ঠায় সরকারি কর্মকর্তা নিয়াজ মোহাম্মদ খান স্মরণীয় অবদান রাখেন। ১৯৪৮ সালে খাদ্য বিভাগের মহাপরিচালক নিয়াজ মোহাম্মদ খান ও জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃষ্ণনগর হাইস্কুলে এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানেই এক জনসভায় গিয়েছিলেন মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমরা উপস্থিত হয়ে দেখলাম এন এম খান ও আব্বাসউদ্দীন সাহেবকে দেখবার জন্য হাজার হাজার লোক সমাগম হয়েছে।’ [পৃ. ১১১] এন এম খান পরে চিফ সেক্রেটারি হয়েছিলেন। তাঁর নামে জনগণ প্রতিষ্ঠা করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘নিয়াজ মোহাম্মদ হাইস্কুল’।

সেকালে স্পোর্টস ক্লাবগুলো পরিচালিত হতো গঠনতন্ত্র অনুযায়ী গণতান্ত্রিক উপায়ে। দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হতেন কর্মকর্তারা। কাউন্সিলররা ভোট দিতেন। ১৭টি বৃহত্তর জেলায় ছিল ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন (ডিএসএ)। তাদের প্রতিনিধিরা ভোট দিতেন। সরকারি দল বা সরকার প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করত না। ক্রীড়ামোদীদের হাতেই ক্রীড়াজগৎ ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকেও ক্লাবগুলোতে জুয়া খেলা হতো। সন্ধ্যার পর কেউ তাস পেটাতেন। হাউজি খেলাও হতো। তবে রাত ১০টার আগেই সদস্যরা ঘরে ফিরতেন। আজকের ক্যাসিনোর এই যে রাজকীয় আয়োজন, জনগণের ধারণার বাইরে। খেলাধুলা ও শরীরচর্চা চাঙ্গে তুলে ক্যাসিনোর কারবার এবং তার সঙ্গে মদ–নারীর উপস্থিতি ক্লাবগুলোর সুনাম ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে।

স্পোর্টস ক্লাবগুলোতে অভিযান অভিনন্দনযোগ্য। মানুষ খুশি হবে যদি এই অভিযান অব্যাহত থাকে এবং এগুলোর সঙ্গে ১০ বছর ধরে যারা জড়িত, তাদের মুখ ও মুখোশটা জনগণ দেখতে চায়। আর সমগ্র বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া দরকার। শত শত কোটি টাকা লেনদেন, শত শত মানুষ যার সঙ্গে জড়িত, তা কেউ জানতেন না, তা কেউ বিশ্বাস করবে না। ক্যাসিনোর যন্ত্রপাতি ধোলাইখালে তৈরি হয় না। জুয়া খেলার বিশেষ গেমিং টেবিল, চিপস, প্লাক, স্লট মেশিন, রুলেট হুইল, বড় বড় কাঠের বাক্স বা পিট আকাশ থেকে পড়েনি। কোনো বিরোধী দলের নেতার কারখানা থেকেও বানানো হয়নি। বিদেশ থেকে এসেছে। এনবিআরের কাস্টমস কর্মকর্তারা কিছুই জানেন না। ঢাকা জেলা প্রশাসন কিছু জানে না। সিটি করপোরেশন কিছু জানে না। ঢাকা জেলা ও মহানগর পুলিশ কিছু জানে না। সীমান্ত পাহারা দেন বিজিবি সদস্যরা। তাঁরাও কিছু জানেন না। তাহলে কি এসব আকাশ থেকে পড়েছে?

ক্লাবের কর্মকর্তারা দায় এড়াতে পারেন না। ক্লাবগুলোতে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কর্মকর্তারা নির্বাচিত হলে এই অবস্থা হতো না। আজ সবখানে সরকারি দলের মনোনীতরাই অধিষ্ঠিত। কারও কোনো মতামতের মূল্য নেই। শিল্প-ব্যবসার চেম্বারের নির্বাচন স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হয় না। ওপর থেকে নির্দেশ আসে। পোশাকশিল্পের সংগঠনগুলোর নির্বাচন হয় আপসের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের ইউনিয়নগুলোতে ক্ষমতাসীনদের বলিষ্ঠ হস্তক্ষেপ। নির্বাচনে প্রার্থী করতে বয়োবৃদ্ধকেও চিরকুটের দ্বারা ভর্তি করে ছাত্রনেতা বানানো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কৃতকর্মের কারণে বদনামের শেষ নেই। কারও কোনো প্রতিবাদ গ্রাহ্য করা হয় না। প্রাপ্তিযোগ ঘটলে হাটহাজারী হোক বা দেশের যেকোনো জায়গার হোক—ধর্মীয় নেতারা নিশ্চুপ। জাতীয় মসজিদের পিলার ভেঙে দোকান বানালেও কর্তার চাকরি যায় না। সব জায়গা থেকে ন্যায়নীতি ও মূল্যবোধ উধাও হয়ে যায়, শুধু ক্যাসিনোর জুয়া কেন, আরও অনেক কিছুই হতে পারে।

রাষ্ট্র কোনো গ্রাম পঞ্চায়েত নয়। রাষ্ট্র এক বিরাট সংগঠন। রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখ দুটি নয়—শত শত। যেকোনো সমাজবিরোধী, অবৈধ কাজ তার চোখে ধরা পড়বেই, তবে সে চোখ যদি খোলা থাকে। ক্লাবগুলোতে যা ঘটে আসছে, তা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়—সামগ্রিক অবস্থার ছোট্ট একটি অংশমাত্র। আশা করি, রাষ্ট্রযন্ত্রের বুজে থাকা চোখ এই ঘটনা থেকে খুলবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক