ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেসের জন্য অপেক্ষা

ঢাকা–কুড়িগ্রাম হয়ে চিলমারী পর্যন্ত সরাসরি ট্রেন চালুর দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে। সেই কাঙ্ক্ষিত ট্রেনটির নাম ওই অঞ্চলের গর্ব ভাওয়াইয়া গানের নামে ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস করার দাবি দীর্ঘদিনের। ছবি: প্রথম আলো
ঢাকা–কুড়িগ্রাম হয়ে চিলমারী পর্যন্ত সরাসরি ট্রেন চালুর দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে। সেই কাঙ্ক্ষিত ট্রেনটির নাম ওই অঞ্চলের গর্ব ভাওয়াইয়া গানের নামে ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস করার দাবি দীর্ঘদিনের। ছবি: প্রথম আলো

২০১৩ সাল। চিলমারী বন্দর থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটি আন্তনগর ট্রেনের আন্দোলন শুরু হয়। সংগঠনের নাম রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি। এর আগে উলিপুর থেকে চিলমারী পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার আন্দোলন সফল হয়। তারও আগে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাঁধের ক্ষতিপূরণ আদায়ের সফল সংগ্রাম পরিচালিত হয়। সংগঠকেরা জানেন, কীভাবে জনগণের মধ্যে বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে হয়। কীভাবে নিশান ওড়াতে হয়। তাই তাঁরা যে ট্রেনের জন্য আন্দোলন শুরু করবেন, তার একটি নামও ঠিক করে ফেলেন। নাম হয় ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস। কারণ, এই গানের মাধ্যমেই তাঁরা সুখ-দুঃখের ভাব ও ভাষা প্রকাশ করেন। বাহে ভাষার দেশ এই অঞ্চল। এটি না বাংলা না অসমিয়া। বাঙালীকরণের মধ্য দিয়ে এটি বিলুপ্তপ্রায়। স্কুল-কলেজে না পড়া ‘ভাগ্যবানরা’ ছাড়া আর কেউ এই ভাষায় কথা বলেন না। কেবল ভাওয়াইয়াতেই জনগণ অতীতে ফেরেন, সম্ভবত ভবিষ্যতেও যাবেন। গাড়িয়াল ভাই যখন কামলা দিতে ঢাকা-চিটাগাং যায়, তখনো তার নারী ভাওয়াইয়াতেই গায়, ‘যদি বন্ধু যাবার চান, ঘাড়ের গামছা থুয়া যান রে...!’

ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেসের নাম শুনেই ট্রেনের বিষয়ে দারুণ উৎসাহী ছিলেন কুড়িগ্রামের সন্তান সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক। প্রধানমন্ত্রীকে সহযাত্রায় বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন সেই কথা। গত কয় মাসে কয়েকবার সংসদ অধিবেশনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনও ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস নামেই আন্তনগর ট্রেন চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রামের প্রতিটি জনসভায় আন্তনগর ট্রেনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই আন্তনগর ট্রেনটি চালু হচ্ছে ১৬ অক্টোবর। কিন্তু কোন নামে?

২.

অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম করে আজ এসে দাঁড়িয়েছি স্বদেশের সীমানায়, কবিতায় লিখেছেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। বাংলাদেশের এক দরিদ্রতম জেলা কুড়িগ্রাম। অথচ ১৯১১ সালের জরিপে দেখা গেছে, অখণ্ড বাংলায় সর্বাধিক অভিবাসীর আগমন ঘটেছে এই জনপদে। উলিপুরের বাহারবন্দ পরগনা ছিল সর্বাধিক রাজস্ব প্রদানকারী পরগনা। চিলমারী নদীবন্দরসহ এই অঞ্চলটিকে বাংলা, আসাম ও কোচ অংশের রাজাদের মধ্যে সেই পাল, সেন ও মুঘল আমল থেকেই যুদ্ধ লেগেই ছিল। সেই অঞ্চলটি কীভাবে দরিদ্রতম অঞ্চলে পরিণত হলো, এ এক গবেষণার বিষয়।

মূলত দেশভাগের ফলে কেন্দ্রীয় চিলমারী-কুড়িগ্রাম অঞ্চল প্রান্তে পড়ে থাকে। ফলে এই অঞ্চলের কারিগর ও কৃষকেরা নিঃস্ব হয়ে যান। তারপর কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়ান দেশময়। বিদেশ যাবেন কিন্তু পুঁজি নেই। তাই ঢাকা-চট্টগ্রামই বিদেশ। রেমিট্যান্স না আসায় এলাকায় বিনিয়োগও হয় না। ফলে নতুন কর্মসংস্থানও হয় না। আটকে গেছে দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্যের চক্রে। আন্তনগর ট্রেনটিকে এই অঞ্চল বিকাশের নতুন সিঁড়ি মনে করছে সবাই।

৩.

আন্তনগর ট্রেনটি চিলমারী থেকে লালমনিরহাট ছুঁয়ে রংপুর-পার্বতীপুর হয়ে ঢাকা যাবে। মানে পুরো ভাওয়াইয়া অঞ্চল ছুঁয়ে যাবে। ভাওয়াইয়া অঞ্চলের বড় একটি অংশকে ছুঁয়ে যাবে। আন্তনগর ট্রেনটির আন্দোলনকারী সংগঠন গণকমিটি যখন 'ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস' ঘোষণা করে, তখনই সব সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন পেছনে এসে দাঁড়ায়, একাত্ম হয়। লেখক ও চিকিৎসক আনোয়ারা সৈয়দ হক কুড়িগ্রামে সৈয়দ শামসুল হকের কবর জিয়ারত করতে এসে জানান, কী দারুণ নাম ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস। উদীচী কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি ড. শ্মাশত ভট্টাচার্য তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, গানের নামে নাম/ ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কলামিস্ট ড. তুহিন ওয়াদুদ লিখেছেন, কী সুন্দর নাম ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস। বিখ্যাত ভাওয়াইয়াশিল্পী ও সংগঠক ভূপতিভূষণ বর্মা লিখেছেন, ভাওয়াইয়ার ধাম/ নদনদীময় কুড়িগ্রাম। মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক উইং কমান্ডার মীর আলী আখতার থেকে প্রবীণ সাংবাদিক সফি খান পর্যন্ত কুড়িগ্রামের সব লেখক ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেসকে সমর্থন জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন।

ইতিহাসে একদিন কুড়িগ্রাম নাম ছিল না, কিন্তু ভাওয়াইয়া ছিল। প্রত্যেকের পরিচয়ের নাম ভাওয়াইয়া। কবির ভাষায়, আমার নাম আমাকে ফিরিয়ে দাও। পারাবত, সিল্কসিটি, পাহাড়িকা, রূপসা, উদয়ন, হাওড়, সুবর্ণ কি সুন্দর সুন্দর নাম। এগুলোর পাশে গানের নামে হোক আন্তনগর ট্রেনের নাম 'ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস'।

নাহিদ হাসান: রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি।
[email protected]