বৈশ্বিক ডানপন্থীদের সংগঠিত করছেন ট্রাম্প ও মোদি

টেক্সাসের হিউস্টনে এক মঞ্চে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি। ছবি: রয়টার্স
টেক্সাসের হিউস্টনে এক মঞ্চে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি। ছবি: রয়টার্স

টেক্সাসের হিউস্টনে গত রোববার অনুষ্ঠিত ‘হাউডি মোদি’ সমাবেশে একরকম আধ্যাত্মিক দ্যোতনা দেখা গেল। যুক্তরাষ্ট্রে সফর করতে এসে সে দেশেরই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এই সমাবেশে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিকেরা এই সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে মোদিকে যতটা না প্রধানমন্ত্রী মনে হচ্ছিল, তার চেয়ে একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে মনে হচ্ছিল। ট্রাম্প সেখানে গিয়ে প্রায় ৫০ হাজার অতিথির সামনে মোদির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। তিনি সেখানে মোদির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

বৈশ্বিক মূলধারার রাজনীতিতে ডানপন্থীরা কীভাবে একটু একটু করে প্রধান হয়ে উঠেছেন এবং কীভাবে এখন তাঁরাই মূলধারা হয়ে উঠেছেন, তা মোদি ও ট্রাম্পের উষ্ণ উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে। কয়েক দশক ধরে কট্টর ডানপন্থীরা গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে কোণঠাসা হয়েছিলেন এবং পার্লামেন্টে তঁাদের জায়গা করে নেওয়া ছিল খুবই বিরল ঘটনা। কালেভদ্রে তাঁরা পার্লামেন্টে অল্প কিছু আসন পেলেও তাঁদের অন্য দলের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। বিংশ শতকের শেষ দুই দশকে রক্ষণশীলেরা নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টে আসনসংখ্যা বাড়াতে পারলেও খুব কম দলই ক্ষমতায় যেতে পেরেছে।

হিউস্টনে গত রোববার যে দুই নেতা হাত মেলালেন, তাঁরা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ও সবচেয়ে বড় ক্ষমতাধর গণতান্ত্রিক দুই দেশের কট্টর ডানপন্থী নেতা। বাস্তবতা হলো তাঁরাই এখন ‘নব্য মূলধারা’। তাঁরা এখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে নিয়মিত বক্তৃতা–বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। ট্রাম্প যেভাবে মূলধারায় নিজেকে মিশিয়ে নিয়েছেন, তা সবারই মোটামুটি জানা। কিন্তু কেউ মোদির আসল চরিত্র ব্যাখ্যা করছেন না।

কট্টর ডানপন্থী মোদি, যিনি বিদেশের মাটিতে ভারতকে একটি ‘আধুনিক, উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি’ বলে বিক্রি করছেন এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী সম্প্রদায় তাঁর কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণও করছেন, সেই তিনি নিজের দেশে উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছেন। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফর করছেন এবং খুব কম জায়গাতেই তাঁকে বিক্ষোভকারীদের মুখে পড়তে হচ্ছে। খুব কম সাংবাদিকই তাঁকে কট্টর ডানপন্থী নেতা হিসেবে বর্ণনা করছেন।

খুব ছোটবেলা থেকেই মোদি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং শোনা যায়, মাত্র আট বছর বয়সে ভারতে তিন তিনবার নিষিদ্ধ হওয়া উগ্র ডানপন্থী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের দীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি। ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিমবিরোধী প্রচারণা চালানো এবং দাঙ্গায় ১ হাজার ২০০ মানুষকে (যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলমান) হত্যার উসকানি দেওয়ার জন্য প্রায় এক দশক তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পাঁচ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

এখন দৃশ্যপট বদলে গেছে। একসময় যে নীতি মোদির জন্য বোঝা হয়েছিল, এখন তা রাজনৈতিক সম্পদে পরিণত হয়েছে। প্রকৃত অবস্থা হলো ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে অন্য যেকোনো বিষয়ের চেয়ে একটি বিষয়ে সবচেয়ে ঐকমত্য আছে। সেটি হলো এই দুজনের মধ্যে ঘোরতর ‘ইসলামবিদ্বেষ’ আছে। এই দুজনই কর্তৃত্ববাদী নীতি গ্রহণ করেছেন। ট্রাম্পের অঘোষিত ‘মুসলিম নিষিদ্ধকরণ’ প্রক্রিয়া এবং মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরে মোদির দমনাভিযান আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দিত হলেও নিজ নিজ দেশের কট্টরপন্থীদের কাছে এই কর্মকাণ্ডের জন্য দুজনই জনপ্রিয় হয়েছেন।

ট্রাম্প এমন একজন কট্টর ডানপন্থী নেতা, যিনি ঐতিহ্যগতভাবে রক্ষণশীল একটি দলকে (রিপাবলিকান পার্টি) বলা যায় ছিনতাই করেছেন এবং ধীরে ধীরে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন দলটির ওপর চাপিয়ে দিয়ে দলটিকে একটি নতুন চেহারা দিচ্ছেন।

মোদি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিজেপির (বিজেপির দাবি অনুযায়ী, দলটির মোট সক্রিয় সদস্যসংখ্যা ১৮ কোটি) নেতা। তিনি ভারতের শতবর্ষী কট্টর ধর্মীয় অনুশাসনের প্রচারক সংঘ পরিবারের প্রোডাক্ট। ট্রাম্প মোদির মতো ছোটবেলা থেকে কট্টর ভাবাদর্শের অনুশীলন না করলেও আচমকা এমন কট্টর নীতির প্রচারক হয়ে উঠেছেন যে সারা বিশ্বে ‘ট্রাম্পিজম’ বলে একটি পরিভাষার জন্ম হয়েছে।

লক্ষণীয় বিষয় হলো দুনিয়াব্যাপী রক্ষণশীল দলগুলো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে, নিজেরা সংগঠিত হচ্ছে। কিন্তু তাদের বিস্তার রুখে দিতে উদারনৈতিক নেতারা এক হচ্ছেন না। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ট্রাম্প বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে সমর্থন দিয়েছেন। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে আগাম সমর্থন দিয়ে রেখেছেন নরেন্দ্র মোদি।

রক্ষণশীলেরা এভাবে যদি সংগঠিত হতে থাকে এবং উদার গণতন্ত্রপন্থীরা যদি নিষ্ক্রিয় থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে বিশ্বের ওপর ভয়াবহ অবস্থা নেমে আসবে।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

ক্যাস মুডি : দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার নিয়মিত কলাম লেখক