যুবলীগের বনেদি 'অনুপ্রবেশকারীরা'

সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছে, তাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারাই ধরা পড়ছেন। সাংসদসহ অনেক নেতার ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। কারও কারও বিদেশযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অনেকে পালিয়ে গেছেন। সব মিলিয়ে অভিযান নিয়ে ক্ষমতাসীন মহলে একধরনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, যদিও নেতারা মুখে স্বীকার করছেন না। অনেকে ইতিমধ্যে গা–ঢাকা দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে জঙ্গি দমনের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধেও জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা করেছিল। পরে এর সঙ্গে মাদকবিরোধী অভিযানও যুক্ত হয়। কিন্তু জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সরকার সফল হলেও দুর্নীতি ও মাদকবিরোধী অভিযানে কেন সফল হতে পারল না, কেন দুর্নীতি আকারে–প্রকারে বেড়ে গেল, সেটি ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যতই অভিযোগ থাকুক না কেন, এ কথা কেউ বলবে না যে তারা জঙ্গিদের আশ্রয় দিয়েছে। বরং দলটি বরাবর জঙ্গিদের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। এ কারণে নানা দুর্বলতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের জঙ্গিবিরোধী অভিযান বহির্বিশ্বেও প্রশংসিত হয়েছে।

আওয়ামী লীগের আমলে দুর্নীতি কমেছে কিংবা কমিয়ে আনতে তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে, সেই দাবি সরকারের অন্ধ সমর্থকও করবে না। সরকারের মন্ত্রী-নেতারা মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ তুললেও দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দিয়ে এসেছেন। দুর্নীতিবাজদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিয়েছেন। একজন উপদেষ্টা বলেছেন, যাঁরা দুর্নীতির দায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জালে আটকা পড়েছেন, তাঁরা অনুপ্রবেশকারী। অর্থাৎ তাঁরা খাঁটি আওয়ামী লীগার নন; বিএনপি থেকে এসেছেন। এই দুর্নীতিবাজেরা বিএনপি আমলে কার কার কাছের লোক ছিলেন সেই তথ্যও উপদেষ্টা মহোদয় দেশবাসীকে জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি যে কথাটি বলেননি তা হলো, একদা মির্জা আব্বাস ও কোকোর (মরহুম আরাফাত রহমান) সহযোগীরা কীভাবে আওয়ামী লীগ নেতাদের সহযোগী হলেন? কিংবা তিনি এ কথাও বলেননি যে কোন আওয়ামী লীগ নেতাকে এই অনুপ্রবেশকারীরা কত টাকা দিয়েছেন। বললে দেশবাসীর জন্য তুলনা করতে সুবিধা হতো।

উপদেষ্টা যদি অনুপ্রবেশের সময়টি আরেকটু পেছনে নিয়ে যেতেন দেখতে পেতেন, বর্তমানে আওয়ামী লীগের নৌকা নিয়ে যাঁরা জাতীয় সংসদে আসীন হয়েছেন, তাঁদের অন্তত ৫০ শতাংশই ‘বহিরাগত।’ তাঁদের কেউ ১৯৯৬ সালের আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন না। অনেক উপদেষ্টাও আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন দলটি ক্ষমতায় আসার পর কিংবা ক্ষমতায় আসবে এই সম্ভাবনা দেখার পর। আওয়ামী লীগের অন্তত দুজন সাবেক সাংসদের কথা জানি, (একজন পরে মন্ত্রীও হয়েছিলেন) যাঁরা ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে অনুশোচনা করেছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগ ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেবার বিএনপিই ক্ষমতায় আসে এবং ওই দুই সাবেক সাংসদের মতো আরও অনেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে আফসোস করেছিলেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নীতি–আদর্শের চেয়ে ক্ষমতাই মুখ্য। আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতা মাঝেমধ্যে খেদ প্রকাশ করে বলেন, ‘রাজনীতি আর রাজনীতিকদের হাতে নেই।’ রাজনীতি যে রাজনীতিকদের হাতে নেই, তার কিছু প্রমাণ পাওয়া গেল বর্তমান ‘শুদ্ধি’ অভিযানে। কিন্তু যে নেতারা আজ আক্ষেপ করছেন, তাঁরা যদি সত্যি সত্যি চাইতেন রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতে থাকুক, তাহলে রাজনীতিটা সঠিক পথে চলতে দিতেন। রাজনীতি সঠিক পথে চলার অর্থ হলো, সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চা। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা।

এর আগে আওয়ামী লীগের নেতারা এই কথিত অনুপ্রবেশকারী ও হাইব্রিড নেতাদের সম্পর্কে গরম গরম কথা বললেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। ভবিষ্যতে নেবেন তারও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের নেতারা শুদ্ধি অভিযানকে সরকারের কৃতিত্ব হিসেবে জাহির করতে চাইছেন। মানলাম। কিন্তু ক্ষমতার অন্দরমহলে এসব দুর্নীতিবাজ কীভাবে ঢুকে গেল সেই প্রশ্নের উত্তর মেলে না। যে গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজ ধরা পড়েছেন, তাঁদের উপকারভোগী কারও কারও নাম ও পদবি সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এখন প্রশ্ন হলো, সরকার সেই উপকারভোগীদের পাকড়াও করতে রাজি আছে কি না। তাঁদের খুঁজে বের না করে শুধু দু–চারজন অনুপ্রবেশকারীকে গ্রেপ্তার করলে কিংবা তাঁদের বাড়িতে অভিযান চালালে লাভ হবে না। একটি পত্রিকার ভাষ্য হলো, শেয়ারবাজারের চেয়ে ক্যাসিনোতে এখন বেশি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। এ থেকে ধারণা করা কঠিন নয় যে, দুর্নীতি কী ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

বাংলাদেশে ক্যাসিনো মানে শুধু খেলা নয়, ক্যাসিনো মানে ক্ষমতা, অর্থ ও প্রতিপত্তি। ‘অনুপ্রবেশকারী’ যুবলীগের নেতা জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান ১৬টি সরকারি প্রকল্পে আড়াই হাজার কোটি টাকার কাজ করছে। তিনি বিএনপি আমলে গণপূর্ত বিভাগের সব কাজ পেতেন। আওয়ামী লীগ আমলেও পাচ্ছেন। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সরকার ও সরকারের অনুমতিপ্রাপ্ত বহু ঠিকাদার থাকলেও একটি প্রতিষ্ঠান কী করে এই বিপুল পরিমাণ অর্থের কাজ পেল, সেই রহস্যও উন্মোচিত হয়নি। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শামীম জানিয়েছেন, কাজ পেতে তাঁকে কোটি কোটি টাকা কমিশন গুনতে হয়েছে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন।

সরকারের মাদকবিরোধী অভিযান কেন সফল হয়নি? সফল হয়নি এ কারণে যে, সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও এর চোরাচালান ও ব্যবসা বন্ধ করতে পারেনি। করতে চায়নি। তারা চুনোপুঁটি বা বাহকদের ধরে ক্রসফায়ারে দিয়েছে। কিন্তু নেপথ্যের কুশীলবেরা রয়ে গেছে বহালতবিয়তে।

একসময় জনসমাবেশের আকার দিয়ে রাজনৈতিক দলে শক্তি পরিমাপ করা হতো। এখন ক্যাসিনোর সংখ্যা দিয়ে যুবসংগঠনগুলো নিজেদের শক্তিমত্তা প্রকাশ করছে। যেসব দেশে ক্যাসিনো আইনসম্মত, সেসব দেশেও একটি শহরে এত ক্যাসিনো নেই। বাংলাদেশে ক্যাসিনো মানে ক্ষমতা, ক্যাসিনো মানে প্রতিপত্তি, ক্যাসিনো মানে অবৈধ অর্থের লেনদেন। গণমাধ্যমের তথ্যমতে, ক্যাসিনোর মালিকেরা ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিতেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতারাও মোটা অঙ্কের অর্থ পেতেন। একজন পুলিশ কর্মকর্তার দাবি অনুযায়ী, চট্টগ্রাম অঞ্চলের এক সাংসদ, যিনি সংসদে হুইপের দায়িত্বও পালন করেন, তিনি ক্যাসিনো ক্লাব থেকে ১৮০ কোটি টাকা আয় করেছেন। পরের খবর হলো, এই কথা বলার পর ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলবে এবং যারাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, লোম বাছতে কম্বল না উজাড় হয়ে যায়। যেখানে সব দুষ্কর্মের সঙ্গে সরকারি দলের নেতারাই জড়িত, সেখানে বিরোধীদের ওপর দায় চাপিয়ে লাভ হবে না। বিএনপি জামায়াত বা অন্য যেই দল থেকেই আসুক না কেন, তাঁরা আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়েই টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি করছেন। ক্যাসিনোর নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

তাই, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা অনুপ্রবেশকারী না বনেদি আওয়ামী লীগার সেই বিতর্ক অবান্তর।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]