মিথ্যাচারের মূল্য বরিস জনসনকে দিতে হবে

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ছবি: রয়টার্স

বরিস জনসন এই জীবনে যদি আর কিছু না–ও করেন, তাহলেও ইতিহাসে তাঁর নাম ইতিমধ্যে খোদাই করা হয়ে গেছে। তিনি এত নির্জলা মিথ্যা কথা বলেছিলেন যে সংবিধানটি প্রায় ভেঙেই ফেলেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট যথার্থই বলেছেন, পার্লামেন্ট স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে তিনি আইন ভঙ্গ করেছেন। যেকোনো নেতা যখন দায়িত্ব নিয়ে উচ্চ পদে আসীন হন, তখন যেকোনো লজ্জাজনক ঘটনার জন্য তাঁর অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত। তবে বরিস জনসনের যা রেকর্ড, তাতে এটা মনে হয় না যে তিনি তেমন একজন ব্যক্তি। তিনি কখনো সত্যের অপরিহার্যতাকে স্বীকৃতি দেননি।

মূলত আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ব্রেক্সিট কার্যকরের অঙ্গীকার করেই জনসন ক্ষমতায় এসেছিলেন। তবে পূর্বসূরি থেরেসা মের মতো তিনিও সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতার এক ‘বৈরী পার্লামেন্টের’ নেতা। তিনি চাইলেও নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারেন না। এ জন্য চলতি মাসের শুরুর দিকে পাঁচ সপ্তাহের জন্য পার্লামেন্ট স্থগিতের ঘোষণা দেন জনসন। এতে ক্ষিপ্ত হয়েছেন এমপিরা। বরিসের নিজ দলের এমপিরাও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, আইনপ্রণেতারা যেখানে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ব্রেক্সিট কার্যকর করার জন্য কাজ করছেন, সেখানে পার্লামেন্ট স্থগিতের ঘোষণা ছিল বড় ভুল। এতে গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণার ওপর চরম প্রভাব পড়েছে। পার্লামেন্ট স্থগিতের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বরিস জনসন বলেছিলেন, সরকারের নতুন নীতিমালা ঠিক করার জন্য রানির পরবর্তী ভাষণ পর্যন্ত পার্লামেন্ট স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এটা ছিল তাঁর মিথ্যাচার। কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করেননি। আসলে এমপিরা যেন ব্রেক্সিট নিয়ে সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনার সুযোগ না পান, সে কারণেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জনসন।

বিচারকেরা পার্লামেন্ট স্থগিত করার পেছনে জনসনের উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিত কোনো আলোচনা করেননি। তাঁরা কেবল বলেছেন, পার্লামেন্ট স্থগিত করার কোনো ভিত্তি তাঁরা খুঁজে পাননি। তাই তাঁরা এটাকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। বিচারকেরা বলেন, এটা আসলে জনসনের ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি উদাহরণ। এখন এই মিথ্যা কথা বলার বা ক্ষমতার অপব্যবহারের মূল্য তাঁকে পরিশোধ করতে হবে। আদালতের এই রায় যেকোনো প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি বড় শিক্ষা। ব্যক্তি যতই ক্ষমতাশালী হোক, এমনকি প্রধানমন্ত্রী হলেও তাঁকে আইন মেনে চলতে হবে। যেহেতু বরিস জনসনের স্থগিতাদেশ অবৈধ, তাই এখন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যত দ্রুত সম্ভব অধিবেশনের ডাক দিতে পারবে। এটা বরিস জনসনের কর্তৃত্বের ওপর একটি বড় ধরনের আঘাত। তবে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় বরিস জনসনকে ফের সংসদ ভেঙে দেওয়ার চেষ্টায় বাধা দিতে পারবে না। চাইলেই তিনি তা করতে পারবেন। তবে তাতে তাঁর যে খুব একটা সুবিধা হবে তা নয়। কারণ, ইতিমধ্যে তাঁর পদত্যাগের দাবি উঠেছে।

ব্রেক্সিটবিরোধীরা হয়তো এটাকে নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখছেন, কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আদালতের এই রায় ইতিমধ্যে জটিল হয়ে ওঠা ব্রেক্সিট প্রক্রিয়াকে আরও সংকটময় করে তুলবে। পার্লামেন্ট স্থগিত না হওয়ার অর্থ এখন দাঁড়াবে, সরকার যাতে চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিট করার সুযোগ না নিতে পারে, তার জন্য এমপিরা এখন নতুন আইন আনার বা নতুন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য আরও সময় হাতে পাবেন। যেহেতু পার্লামেন্টে জনসনের দল সংখ্যালঘিষ্ঠ, তাই তিনি কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারেন না। এ জন্য তিনি একটি আগাম নির্বাচন চাইছিলেন, যাতে ৩১ অক্টোবরের মধ্যেই ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া মসৃণভাবে সম্পাদন করতে পারেন। কিন্তু হাউস অব কমন্সে দুবার আগাম নির্বাচনের প্রস্তাব আনলেও এমপিদের ভোটাভুটিতে ব্যর্থ হন।

জনসনের সমর্থকেরা এখন ঘোর অন্ধকার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁরা জানেন যে জনসন মিথ্যাবাদী। তাঁরা আরও জানেন যে তাঁদের দলে তাঁর নেতৃত্বের এখন আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। তবে জনসনের সঙ্গে আটকে থাকার দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে বাস্তবসম্মত, তাঁদের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলো জনসনের সঙ্গে যুক্ত। যদি তিনি পড়ে যান, তাহলে তাঁরাও পড়ে যাবেন। দ্বিতীয়টি আদর্শগত, জনসন তাঁর কর্মজীবন বন্ধক রেখেছেন এমন কট্টরপন্থীদের কাছে, যাঁরা ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দাবি করছেন। তিনি তাঁদের সমর্থন নিয়েই কনজারভেটিভ দলের নেতৃত্ব জিতেছিলেন। তাই আদালতের এই রায় বরিস জনসনের সমর্থকদের জন্যও একটি বড় ধাক্কা।

জনসন প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে তিনি সংসদের সম্মতিতে দেশ পরিচালনা করবেন এবং জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবেন। ব্রিটেনের রানি স্বয়ং তাঁর নিয়োগ চূড়ান্ত করেন। এর চেয়ে উচ্চতর কোনো পদ নেই, যার মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা যায়। কিন্তু যেকোনো ধরনের স্বেচ্ছাচার যে এই পদে থাকাটাকে হুমকির মুখে ফেলে, তার প্রমাণ বরিস জনসন। এখন দেশের এই টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি কদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেন, সেটাই দেখার অপেক্ষা।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
রাফায়েল বের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার কলামিস্ট