সামাজিক ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন

শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, দায়িত্বশীল নেতৃত্বের জ্ঞাতসারেই ক্যাসিনোগুলো চলেছে
শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, দায়িত্বশীল নেতৃত্বের জ্ঞাতসারেই ক্যাসিনোগুলো চলেছে

দেরিতে হলেও ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তাতে বলা যায়, ‘দের অয়ে দুরুস্ত অয়ে’ (দেরি হলেও সঠিক হয়েছে)। বহুদিন থেকে সুধী সমাজ, যারা দল করে না—বলা হচ্ছে যে দেশে সুশাসনের অভাবের কারণে রাষ্ট্রের কাঠামোতে ফাটল ধরেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক দল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থা নয়, বরং জনগণের সম্পদ। কাজেই যেকোনো রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় থাকে বা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের কর্মকাণ্ড সর্বতোভাবে জনগণের মনমানসে থাকে। এটাকে ‘পাবলিক পারসেপশন’ বলে। পাবলিক পারসেপশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলের অঙ্গসংগঠনের দুষ্কৃতকারী ও দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে যে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন বলে দৃশ্যমান, তা কার্যকর পরিণতি পাবে—তা-ই আমরা সাধারণ জনগণ আশা করি।

এ কদিনে র‍্যাব-পুলিশের অভিযানের মধ্য দিয়ে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা নিয়ে প্রথমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা যুবলীগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী। তিনি এই প্রক্রিয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, যা পক্ষান্তরে তাঁরই দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের বিরুদ্ধে গেছে। অবশ্য তিনি পরে নিজেকে শুধরিয়ে নিয়েছেন। তিনি যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, তার প্রেক্ষাপট ছিল এবং ‘আঙুল চোষার’ মতো ভাষা ব্যবহার করলেও তিনি তার ব্যাখ্যা দেননি। তবে তাঁর সেই প্রতিক্রিয়া থেকে মনে হতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগে তাঁরই দলের অনেকে খুশি হতে পারেননি।

ওমর ফারুক চৌধুরী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মধ্যে যে কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছেন, তার দু-একটি অবশ্যই বেশির ভাগ নাগরিকেরও প্রশ্ন। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে অভিযোগের অাঙুল তুলে বলেছেন, এত দিন তাদের নাকের ডগায় এসব চলছিল কীভাবে? এবং এখন পত্রপত্রিকার মারফত জানা যাচ্ছে যে কোথাও কোথাও তাদের ছত্রচ্ছায়ায় ক্যাসিনোগুলো চলেছে। এ প্রশ্নের প্রথাগত জবাব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বোচ্চ মহলও দিতে পারবে বলে মনে হয় না, বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসন। তবে অনেক কথা বা কারণ প্রকাশ্যে বলা না হলেও অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে আমাদের দেশের পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্ষমতাসীনদের দাপটে শুধু ক্ষমতাহারাই হয়নি, বরং সমাজে তাদের অবস্থান এবং জনমনে আস্থার জায়গা অনেক নিচে নেমে গেছে। এরই কারণে সড়ক থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় এবং সংস্থায় আইন অমান্য করার প্রতিযোগিতা দেখা যায়। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বিগত চার বা তার চেয়ে বেশি বছর আগে থেকে বিভিন্ন ক্রীড়া ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনো বসানো হয়েছে। পুলিশ তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারছে না রাজনৈতিক কারণে। যার খেসারত এখন প্রায় সব সংগঠন, রাজনৈতিক অঙ্গন ও অনেক রাজনীতিবিদকে দিতে হবে।

বিভিন্ন তথ্যে এ পর্যন্ত যেসব চিত্র ফুটে উঠেছে, তা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, দায়িত্বশীল নেতৃত্বের জ্ঞাতসারেই পানি এত দূর গড়িয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে কোনো নেতাকে, এমনকি বিরোধী শিবির থেকেও কোনো কথা বা প্রতিবাদ করতে শোনা যায়নি, যা এখন শোনা যাচ্ছে। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বলছে যে এসব ঘটনা আগে তাদের জানা ছিল না! তাহলে যাদের জানানোর দায়িত্ব ছিল, তারাও তো ওই মন্ত্রণালয়ের অধীনের সরকারি সংগঠন, তাদের জবাবদিহির বিষয়টি অবশ্যই জনমনে স্বাভাবিকভাবেই উঠে এসেছে।

ক্যাসিনো এবং একে ঘিরে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, তার মধ্যে রয়েছে কীভাবে শুল্ক বা বিনা অনুমতিতে এসব জুয়া খেলার আধুনিক বৈদ্যুতিক সামগ্রী দেশে প্রবেশ করেছে। এই উপমহাদেশে নিকটতম প্রাপ্তিস্থান হতে পারে নেপাল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, ১১ জন নেপালির ছবি—যাঁদের হাত দিয়েই ক্যাসিনো ব্যবসা বড় হয়ে এই পর্যায়ে এসেছে। নেপালিরা বিভিন্ন ক্লাবের অন্তরালে ক্যাসিনোর কারিগরি ও জুয়া পরিচালনা করতেন। নেপালিরা শুধু এখানে ক্যাসিনোগুলো পরিচালনাই করতেন না, বাংলাদেশিদের প্রশিক্ষণও দিতেন বলে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ।

এসব বাংলাদেশি যুবক হয়তো দেশের অন্যান্য শহরে এ ধরনের ক্যাসিনো গড়ে তুলেছেন অথবা ওই পর্যায়ে থাকতেও পারেন। ঢাকার বাইরেও এ ধরনের সম্ভাব্য স্থানের খোঁজে রয়েছে গোয়েন্দা বাহিনী। প্রসঙ্গত, নেপালের বহু পাঁচ তারকা হোটেলে ক্যাসিনো এবং সব ধরনের জুয়া বৈধ এবং রাষ্ট্রের বৈধ আয়ের পথ। নেপালে প্রকৃতি ছাড়াও সত্তরের দশকে গাঁজা ও জুয়া বৈধ আয়ের পথ ছিল। এখন গাঁজার আসর না থাকলেও ক্যাসিনো ও অন্যান্য জুয়ার জন্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে। শুধু কারিগরি পরিচালনাই নয়, চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে নারীদেরও নিয়োজিত করা হয়েছিল। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন থাকছে যে এত বিদেশির বাংলাদেশে যুক্ত হতে ওয়ার্ক পারমিটের প্রয়োজন হয় কি না। হয়ে থাকলে এত দিন এতজন বিদেশি নারী-পুরুষ অবৈধভাবে কীভাবে প্রশাসনের নাকের ডগায় এ ধরনের বেআইনি কাজে জড়িত ছিলেন? সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের অবহেলা কতখানি ছিল?

স্মরণযোগ্য যে আমরা মাত্র তিন বছর আগে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার শিকার হয়েছি। দেশে জঙ্গি তৎপরতা উৎখাত হয়নি। নতুন নতুন গোষ্ঠীর আবির্ভাব হচ্ছে বলে তথ্যে প্রকাশ। বিশ্বব্যাপী জঙ্গি সংগঠনের অর্থায়ন নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে, তাতে বিশদভাবে আলোচিত ও প্রমাণিত হয়েছে যে এই ধরনের উগ্র সংগঠনগুলোর অর্থের উৎস প্রটেকশন মানি এবং অর্থ এ ধরনের বেআইনি উৎস থেকেই পাওয়া যায়। চাঁদাবাজ ও বড় বড় ঠিকাদারের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা প্রদানের বিপরীতে অর্থায়ন। শুধু অবৈধ জুয়া বা ক্যাসিনোর কালোটাকাই নয়, যেকোনো কালোটাকার উৎস সন্ত্রাসের অর্থায়নের অন্যতম উৎস। এ প্রসঙ্গে ইন্টারপোলের এক গবেষণায় বলা হয় যে যেকোনো অবৈধ পন্থা বা ব্যবসার অর্থ সন্ত্রাসীদের অর্থায়নের অন্যতম উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আরও বলা হয় যে যেসব দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তেমন জোরালো নয়, সেসব দেশেও এ ধরনের আয়ই সন্ত্রাসীদের বা জঙ্গিদের অর্থের উৎস। ফলে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। এ পর্যন্ত যতটুকু উদ্‌ঘাটিত এবং আলোচিত হয়েছে, তার সঙ্গে নাগরিক ও সামাজিক নিরাপত্তা যেমন যুক্ত, তেমনি অভ্যন্তরীণ জাতীয় নিরাপত্তাও যুক্ত।

এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার উপসংহার টানার আগে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাব্যবস্থায় ভিআইপি নিরাপত্তা প্রটোকলের অনুকরণে তথাকথিত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে প্রকাশ্যে চলাফেরা ও প্রটোকল আইনসিদ্ধ কি না—এ প্রশ্নের কোনো ব্যাখ্যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া যায়নি। এ প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। রাজধানীর রাজপথে সামনে-পেছনে নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করে ট্রাফিককে এড়িয়ে চলাফেরার যে প্রবণতা দেখা যায়, সেগুলো কতখানি আইনসিদ্ধ, সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নজর দেবে বলে আশা করি। সংবাদমাধ্যমের খবরে আমরা জেনেছি যে সম্প্রতি আটক একজন যুবলীগ নেতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আদলে তঁার নিজস্ব বাহিনী নিয়ে চলতেন এবং সেই রক্ষীরা মোটরসাইকেল ব্যবহার করতেন।

যাহোক, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকারি দলের অঙ্গসংগঠন এবং অন্যান্যের বিরুদ্ধে যে শুদ্ধি অভিযান চলছে, তা যেন মাঝপথে থেমে না যায়। সাধারণ মানুষ এ ধরনের অভিযান ও ব্যবস্থার মধ্যে আশার আলো দেখতে চায়। প্রধানমন্ত্রী যদি এতে সফল হন, তবে তাঁর ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা আরও বাড়বে।

শেষ করার আগে উল্লেখ করতে চাই যে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি ছাত্রলীগের পর যুবলীগকে ধরেছেন। অনেকেই মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী এখানেই থেমে থাকবেন না। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দৃঢ় থাকবেন। আশা করি, শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনেই নয়, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অব্যবস্থাপনা এবং বিভিন্ন দুর্নীতির বিষয়টির দিকেও নজর দেবেন।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে অনারারি ফেলো এসআইপিজিএনএসইউ
[email protected]