উপাচার্যরা কেন পদের মর্যাদা রাখতে পারেন না

শুক্রবার যখন এই কলাম লিখি, তখন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের নবম দিন চলছিল। এদিন তাঁরা উপাচার্যের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছেন, লাল কার্ড মিছিল করেছেন। এর আগে ঝাড়ুমিছিল করেছেন। আন্দোলনের মুখে উপাচার্য খন্দকার নাসিরউদ্দিন কার্যত ‘গৃহবন্দী’। অফিসে যান না। ঘরে বসেই প্রশাসনিক কাজকর্ম চালান। বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এ পর্যন্ত তিনজন সহকারী প্রক্টর পদত্যাগ করেছেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার পদত্যাগকারী মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম লেখেন, ‘…সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রশাসনবিরোধী অহিংস আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগত সন্ত্রাসীরা অন্যায়ভাবে হামলা চালালে ২০ জনের বেশি শিক্ষার্থী আহত হয়, যার মধ্যে আমার বিভাগের দুই শিক্ষার্থীও রয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত মনে জানাচ্ছি যে উক্ত অহিংস শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময় অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ কোনো রকম কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি, বরং ছাত্রদের ওপর বহিরাগত সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।...আমার সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও প্রশাসন কর্তৃক দায়িত্বে অবহেলার প্রতিবাদে আমি আমার প্রশাসনিক পদ থেকে পদত্যাগ করছি।’

কেবল তিন সহকারী প্রক্টর নন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারাও ক্যাম্পাসে এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন।

এই উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তিনি কথায় কথায় শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করেন। সর্বশেষ আইন বিভাগের ছাত্রী ফাতেমা-তুজ-জিনিয়াকে বহিষ্কারের পর আন্দোলন জোরদার হয়। তাঁর বিরুদ্ধে িনয়োগ ও পদায়নে অনিয়ম ছাড়াও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ আছে। যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিজের ভাতিজাকে সেকশন কর্মকর্তা থেকে প্রথমে প্রভাষক ও পরে সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। উপাচার্য ছয় লাখ টাকা দিয়ে একটি বনসাই লাগিয়েছেন ক্যাম্পাসে, যার দাম ৬০ হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।

বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের সঙ্গে চলতি বছরের মার্চ মাসে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনের মিল লক্ষ করা যায়। সেখানেও শিক্ষার্থীরা প্রথমে পরীক্ষার ফি কমানোসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন। কিন্তু উপাচার্য ইনামুল হক আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালমন্দ করলে আন্দোলন উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে রূপ নেয়। সেখানে বেশির ভাগ শিক্ষক আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে বাধ্যতামূলকভাবে ছুটি নিয়ে মেয়াদ শেষ করতে হয়। তিনি আর ক্যাম্পাসে আসতে পারেননি। এখানেও উপাচার্য শিক্ষার্থীদের প্রকাশ্যে গালাগাল করেছেন। তিনি আন্দোলন রহিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সেই নির্দেশ অমান্য করেই ক্যাম্পাসে আছেন এবং আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। প্রথম আলোর গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি নুতন শেখকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘সবকিছু অচল’। এই পরিস্থিতিতে ১ অক্টোবর থেকে যে স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা বলেছেন, উপাচার্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।

ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে। ইউজিসির সদস্য মুহম্মদ আলমগীরের নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত দল গতকাল পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ছিল। তঁারা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। উপাচার্য বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে যে এক নারী কর্মচারী অভিযোগ এনেছিলেন, তা অনেক আগেই প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কিন্তু অভিযোগ প্রত্যাহার করলেই প্রমাণিত হয় না তিনি নির্দোষ। অনেক সময় ভয়ভীতির কারণেও অভিযোগকারী তাঁর অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। বিশেষ করে যখন অভিযুক্ত ক্ষমতাবান হন।

২.

কয়েক দিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম সেখানে চলমান আন্দোলন সম্পর্কে জানতে। এটি দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। প্রচুর গাছপালাশোভিত সবুজঘেরা ক্যাম্পাসটি খুবই সুন্দর। সেখানে ভালো লাগার আরও কিছু বিষয় চোখে পড়ল। ক্যাম্পাসে যেখানেই রিকশায় যাবেন, ভাড়া ১০ টাকা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও ছাত্রীর অনুপাত প্রায় সমান—৫১: ৪৯। ছাত্রছাত্রী হলের সংখ্যাও সমান ৮: ৮। ক্যাম্পাসে শতাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠন কাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে। এতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আনন্দিত হওয়ার কথা। িকন্তু আলাপ করলে তাঁরা খেদের সঙ্গে বলেন, অতীতে এখানে আবাসিক ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। ফলে কিছুদিন না যেতেই সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তা ছাড়া আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সব স্থাপনাই হতে হবে পরিকল্পিত ও পরিবেশসম্মত।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ হচ্ছে, সেখানেও দুর্নীতির আশঙ্কা করছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে ছাত্রলীগ নেতাদের কমিশন ভাগাভাগির খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তবে আন্দোলনের মধ্যেও সেখানে ক্লাস-পরীক্ষা ঠিকমতো চলছে। আমরা ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখলাম, ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে। রাস্তার দুই পাশে খুঁটি গেড়ে ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। বেশির ভাগই জেলার নামে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসেন, তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করেন আবাসিক ছাত্রছাত্রীরাই। এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। এ জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রছাত্রীরা ধন্যবাদ পেতে পারেন।

আন্দোলনকারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তাঁরা ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে বলেছেন। অন্যথায় ১ অক্টোবর থেকে কঠোর কর্মসূচি নেওয়া হবে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, তদন্তের আগে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি অযৌক্তিক।

৩.

কেবল এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ আছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ জন বর্তমান ও সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিয়ে ইউজিসি তদন্তকাজ শুরু করেছে। যেসব পদাধিকারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আছে, তার মধ্যে আছে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আলাউদ্দিন, ঢাকার ইসলামিক আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এস এম ইমামুল হক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. আবদুস সাত্তার, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম অহিদুজ্জামান, ময়মনসিংহের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোস্তাফিজুর রহমান, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. মতিয়ার রহমান হাওলাদার, দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মু. আবুল কাশেম এবং রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কামাল উদ্দিন আহাম্মদ।

প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ আছে। যিনি উপাচার্য হন, দল ভারী করতে তিনি অনুগতদের শিক্ষক পদে নিযোগ দেন। একজন উপাচার্য তো একবার প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ছাত্রলীগ করাটাই চাকরি পাওয়ার একমাত্র যোগ্যতা। তবে এসব অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর হলো নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম অহিদুজ্জামান ইউজিসি গঠিত তদন্ত দলকে তদন্ত করতে বাধা দিয়েছেন। তদন্তকারী দল যখন নোয়াখালী সার্কিট হাউসে অবস্থান করছিল, তখন মোটরসাইকেল আরোহী একদল ক্যাডার গেটে মহড়া দেন এবং বলেন, ‘তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারবেন না। ঢাকায় ফিরে যেতে হবে।’ বাধ্য হয়ে তাঁরা তদন্ত না করেই ফিরে আসেন। ইউজিসির একজন সাবেক চেয়ারম্যানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘অভিযোগটি এসেছিল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে।’ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের পাঠানো অভিযোগের তদন্তকাজ যখন একজন উপাচার্য গায়ের জোরে থামিয়ে দেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কীভাবে আশা করা যায়?

আমাদের উপাচার্যরা সব ক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টি করে চলেছেন। সম্প্রতি টাইমস হায়ার এডুকেশন বিশ্বের এক হাজার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তালিকা তৈরি করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের এসব নিয়ে মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হয় না।

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক মেধাবী ও যোগ্যতর শিক্ষক আছেন। কিন্তু তাঁরা উপাচার্য পদে নিয়োগ পান না। দু–একটি ব্যতিক্রম বাদে এ পদে তাঁরাই নিয়োগ পান, যঁারা দলবাজি করেন, অনিয়ম ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন। শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের স্বার্থ তঁাদের কাছে গুরুত্ব পায় না। গুরুত্ব পায় নিয়োগকর্তার সন্তুষ্টি। এটাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য পদের মর্যাদা এবং শিক্ষার মান রক্ষার প্রধান অন্তরায় বলে মনে করি।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]