একটি সমাবেশ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া

কেউ বলছেন পাঁচ লাখ, কেউ বলছেন তার চেয়ে বেশি; কেউবা বলছেন লাখ দুয়েকের বেশি হবে না। বিশাল সমাবেশে মাথা গুনে জনসংখ্যা নির্ণয় করা যায় না। উখিয়া-টেকনাফের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে অভিন্ন কোনো সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেল না। তবে গত ২৫ আগস্ট কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের সমাবেশে লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ যে হয়েছে, এ বিষয়ে কারও সংশয় নেই। এত বড় সমাবেশ এখানকার বাসিন্দারা আর কখনো দেখেনি। এক মাস অতিক্রান্ত হলেও তাই এই সমাবেশের কথা এখনো তাঁদের মুখে মুখে।

সত্যি বলতে কি, এই বিশাল সমাবেশ ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দাদের। এক ডাকে এত লোক জড়ো করার সামর্থ্য যাদের আছে, তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এটি স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ, নাকি এর পেছনে কারও ইন্ধন ছিল? উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে যেসব দেশি-বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করছে, তাদের কোনো কোনোটির মধ্যে দুরভিসন্ধি আছে কি না, এ নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে শঙ্কা-সংশয় আছে। তা ছাড়া, সমাবেশের জন্য অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কি না, এ নিয়ে সরকারের লোকজনেরই নানা বক্তব্যে বিভ্রান্তি বেড়েছে।

স্থানীয় অধিবাসীরা আতঙ্কিত, কারণ এখানে নানা সময়ে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ঘটেছে, এসব ঘটনা সহিংস রূপও নিয়েছে। কিন্তু এভাবে একত্র হতে পারার শক্তিটা যদি অনুভব করতে পারে রোহিঙ্গারা, তাহলে তাদের মধ্যে যে দুর্বৃত্ত ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি আছে, তারা ইতিমধ্যে সংখ্যালঘু হয়ে পড়া স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে (রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ, স্থানীয় বাসিন্দা সাড়ে ৫ লাখ) কোণঠাসা করে ফেলতে পারে। পত্রিকান্তরে এমন উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরীর বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আমাদের রেড সিগন্যাল দিয়েছে।’

উখিয়া কোর্টবাজার এলাকায় কবি ও সাংস্কৃতিক কর্মী আদিল চৌধুরীর কাছে স্থানীয় লোকজনের শঙ্কার যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি তাঁর লেখা তিনটি নিবন্ধের ফটোকপি এই লেখককে দিয়ে বলেন, ‘আমার বক্তব্য এখানে আছে।’ তাঁর একটি নিবন্ধের শিরোনাম ‘একটি ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠার অপেক্ষায়।’ তাতে এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘...এই অগ্ন্যুত্পাত কখন হতে পারে? বিশাল রোহিঙ্গা শরণার্থী অধ্যুষিত এলাকাটির জনজীবনে অগ্নি–উদ্‌গিরণ কখন শুরু হবে, তার দিনক্ষণ হয়তো বলা যাবে না, তবে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে অল্প অল্প ধোঁয়া দেখে যে কেউ বলবে বিপদ আসন্ন।’

কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরসংলগ্ন মাঠে জনসভা আয়োজনের ব্যাপারে রোহিঙ্গা শিবিরে কিছু অনলাইন টিভিতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। রোহিঙ্গা শিবিরে অন্তত ১০টি অনলাইন টিভি দীর্ঘদিন চালু ছিল। রোহিঙ্গারা মুঠোফোনে তাদের ভাষায় প্রচারিত অনলাইন টিভি চ্যানেলের খবর দেখে। এসব চ্যানেলের বেশির ভাগ প্রচারিত হয় দেশের বাইরে থেকে, বিশেষ করে দুবাই, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া থেকে। এসব চ্যানেলে প্রচারের জন্য উখিয়া-টেকনাফ ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন ফুটেজ পাঠানো হয়।

টেকনাফ মসজিদ মার্কেটের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবদুল গনি বলেন, এই অনলাইন টিভি চ্যানেলগুলো খুবই বিপজ্জনক। কারণ, শিবিরে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ লোকের হাতে মুঠোফোন আছে। যদি কোনো অপপ্রচার বা গুজব এই চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত হয়, তাতে এখানে বড় ধরনের দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বেধে যেতে পারে। এই অনলাইন টিভিগুলোতে বাংলাদেশ ও বাঙালিবিরোধী প্রচারণার দু-একটা ভিডিও ক্লিপ ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

এসব তৎপরতা বন্ধ করতে সম্প্রতি প্রশাসন রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় থ্রি–জি, ফোর–জি মুঠোফোন সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে। তবে এই উদ্যোগ যথেষ্ট কার্যকর ও বাস্তবসম্মত বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। কারণ, এর আগে আরাকান রাজ্যে থাকাকালেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশিদের নামে ৩ লাখ সিম সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছে। তা ছাড়া, রোহিঙ্গাদের অনেকেরই কাছে আছে মিয়ানমারের মোবাইল কোম্পানিগুলোর সিম। সেই কোম্পানিগুলো সীমান্তবর্তী এলাকায় টাওয়ার বসিয়ে থ্রি–জি, ফোর–জি সেবা চালু করায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে মুঠোফোনের ব্যবহার দুঃসাধ্য নয়। এ ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের নাম-পরিচয় অনুযায়ী মুঠোফোনের সিম সংগ্রহ ও ব্যবহার করার অনুমতি দিলে নিয়মিত নজরদারি করা সম্ভব হতো বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিন্তু নিজের বাড়ি থেকে যুবলীগের নেতা ওমর ফারুককে তুলে পাহাড়ের অভ্যন্তরে নিয়ে গিয়ে খুন করার ঘটনায় সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ২০১৭ সালে যখন বাস্তুহারা রোহিঙ্গারা দলে দলে এ দেশে আসছিল, তখন যাঁরা মানবিক কারণে এসব অসহায় মানুষকে আশ্রয় ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ওমর ফারুক ছিলেন অগ্রগণ্য। ওমর ফারুকের মৃত্যুর পর তাঁর এই মানবিক কর্মকাণ্ডের ছবি স্থানীয় পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হলে উখিয়া-টেকনাফের বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ মিছিল, সড়ক অবরোধ ও রোহিঙ্গা শিবিরে হামলার ঘটনা ঘটেছিল। পরে প্রশাসনের আশ্বাসে এলাকাবাসী অবরোধ তুলে নেন। ওমর ফারুকের হত্যাকাণ্ডের পর এ পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন অন্তত সাতজন রোহিঙ্গা। পুলিশ প্রশাসনের এই কড়া পদক্ষেপ দুর্বৃত্তদের যেমন আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে, তেমনি সাধারণ নিরীহ রোহিঙ্গাদেরও দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। কারণ, বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের বড় অংশটিই নিরুপদ্রব এবং শান্তিপূর্ণ জীবন ও পরিবেশ চায়।

উখিয়া থেকে কক্সবাজার শহরে এসে পৌঁছানোর দিন (১৪ সেপ্টেম্বর) গভীর রাতে খবর পেয়েছিলাম, টেকনাফের শালবন শিবিরে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ওমর ফারুক হত্যাকাণ্ডের একজন রোহিঙ্গা আসামি। পরদিন সকালে রওনা দিয়েছিলাম টেকনাফের উদ্দেশে। যে এলাকায় বাস করতেন ওমর ফারুক, সেই জাদিমোরার একটি শিবিরে গিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষণ্ন ও উদ্বিগ্ন চেহারা দেখেছি। ২৭ বছর বয়সী ইউএনএইচসিআরের পরিচ্ছন্নতাকর্মী কেফায়েত উল্লাহ থেকে শুরু করে ৭০ বছর বয়সী হোসেন আহমদ—সবার কথায় মনে হলো, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে থাকতে চান তাঁরা। কিছু দুর্বৃত্তের জন্য বাঙালি ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে অশান্তি ও উত্তেজনা বিরাজ করছে বলে তাঁদের ধারণা। কুতুপালং এলাকায় রোহিঙ্গাদের বিশাল সমাবেশ ও ওমর ফারুক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে বলেও দাবি করলেন তাঁরা। মো. ইয়াছিন নামের এক তরুণ ও তাঁর মা রাজুমা খাতুন বললেন, ‘ওমর ফারুক ছেলেটি বড় ভালো ছিল।’

একটি খুনের ঘটনা ও একটি বিশাল সমাবেশ রোহিঙ্গা শরণার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে বিভেদ বাড়িয়ে তুলেছে, এ কথা মনে করেন কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনও। তবে দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার জন্য পুলিশ প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে
বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘একদিকে হত্যাকারীদের শাস্তি দিয়ে রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তদের কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। আমরা তাঁদের বোঝাতে চাই, যাঁরা আপনাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে বিরোধে জড়াবেন না। অন্যদিকে স্থানীয়দেরও বুঝিয়ে বলেছি, রোহিঙ্গারা এখানে আছে, প্রত্যাবাসনে বিলম্ব হচ্ছে—এটা বাস্তবতা। তারা অপরাধ করলে আমরা ব্যবস্থা নেব। আপনারা সংঘাত এড়িয়ে চলুন।’

পুলিশ প্রশাসনের এসব কথায় আমরা আশ্বস্ত হতে চাই। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যত প্রলম্বিত হবে, স্থানীয় ব্যক্তিরা তত হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবেন, এটাই স্বাভাবিক। এখন মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ বাড়াতে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতার সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
[email protected]