আইনস্টাইন কি কিশোর আলো পড়ছেন?

আইনস্টাইন যে ল্যাবরেটরিতে কাজ করতেন, তার সামনে দিয়ে আমরা হাঁটছিলাম। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টা ঘুরেফিরে দেখাচ্ছিলেন ড. এম জাহিদ হাসান। আর আমার সঙ্গে আছেন আমার শিক্ষক গোলাম কবির। 

জাহিদ হাসান নিজে বড় বিজ্ঞানী, বড় গবেষক। আইনস্টাইনের ল্যাবরেটরিতেই তিনি এখন কাজ করেন। তিনি আবিষ্কার করেছেন ভাইল ফারমিয়ন কণা, বিজ্ঞানীরা যার সন্ধান করছিলেন ৮০ বছর ধরে। জাহিদ হাসান জানান, আইনস্টাইন বলে গেছেন, এখানে তাঁর নামে কোনো স্মারক বা ভাস্কর্য রাখা যাবে না। তাই কোন চেম্বারে তিনি বসতেন, তার কোনো চিহ্ন নেই।

জাহিদ হাসান যখন ঢাকায় এসেছিলেন, আমরা তাঁকে এনেছিলাম এক কিশোর সমাবেশে। কিশোর আলো আর বিজ্ঞানচিন্তার ছেলেমেয়েরা তাঁকে প্রশ্ন করছিল। তিনি উত্তর দিচ্ছিলেন।

একজন কিশোর প্রশ্ন করেছিল, আমরা যে কিশোর আলোয় আসি, আপনারা ছোটবেলায় কী করতেন? 

জাহিদ হাসান উত্তর দিয়েছিলেন, আমাদের সময়ে তো কিশোর আলো ছিল না। তোমাদের মতো এত সুযোগসুবিধা ছিল না।

তবে জাহিদ হাসান যেতেন ড. আবদুল্লাহ আল–মুতী শরফুদ্দীনের কাছে। তিনি লিখতেন বিজ্ঞান সাময়িকী পত্রিকায়। ছোটবেলাতেই তাঁর অনেক লেখা বেরিয়েছিল। তাঁর বই আছে—এসো ধূমকেতুর রাজ্যে। 

জাহিদ হাসানের মতো বড় বিজ্ঞানী ছোটবেলায় লিখতেন, কাগজ অফিসে যেতেন। তিনি আফসোস করেছেন, বিনয়বশত যে তাঁদের ছোটবেলায় কিশোর আলো ছিল না। আহা, যদি থাকত!

আমি রসিকতা করে বলি, আইনস্টাইন পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেছেন, কিশোর আলো না পড়লেও মানুষ হওয়া যায়। কারণ, আইনস্টাইন কিশোর আলো পড়েননি। কারণ, তাঁর সময়ে কিশোর আলো ছিল না।

তবে কিশোর আলো থাকলে নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের আইনস্টাইন, ভবিষ্যতের রবীন্দ্রনাথরা না পড়ে ছাড়বেন না।

কারণ, শুধু পরীক্ষার পড়া পড়লে জীবনে সফল হওয়া যায় না। সবাই আইনস্টাইন হবে না, সবাই রবীন্দ্রনাথ–নজরুল হবে না, কিন্তু আমরা চাই, সবাই ভালো মানুষ হব।

আইনস্টাইন বলেছেন, ‌‘জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা মূল্যবান’।

ভালো মানুষ হতে হলে কাগজের বই পড়তে হবে, কাগজের পত্রিকা পড়তে হবে। আমরা যখন একটা উপন্যাস পড়ি, তখন কয়েক ঘণ্টার জন্য চারপাশ ভুলে যাই; আমরা পথের পাঁচালীর দুর্গার জন্য কাঁদি, আমরা আমার বন্ধু রাশেদ–এর জন্য কাঁদি। এটা আমাদের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি করে, আমাদের অনুভূতিগুলোকে গাঢ় করে। 

চারপাশে শিশু–কিশোরদের সামনে নষ্ট হওয়ার অনেক দরজা খোলা—মাদক, গ্যাং, সন্ত্রাস, চরমপন্থা—কত কী! আমরা নয়ন গ্যাংয়ের খবর পড়ে শিউরে উঠি। শিশু–কিশোরদের আমরা রক্ষা করব কী করে? খেলার মাঠ নেই। সারাক্ষণ মুঠোফোনে সে মুখ গুঁজে আছে। সে কী করছে, আমরা কি জানি?

তাদের রক্ষার একটা পথ, তা হলো বইয়ের নেশা ধরিয়ে দেওয়া। কাগজের নেশা ধরিয়ে দেওয়া। তাদের হাতে কিশোর আলো তুলে দেওয়া।

আজ কিশোর আলোর ৬ নম্বর জন্মদিন। কিশোর আলো বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত ম্যাগাজিন। বহু দৈনিক পত্রিকার চেয়ে কিশোর আলো বিক্রি হয় অনেক বেশি। কিআর পাঠকেরা গণিত অলিম্পিয়াডে চ্যাম্পিয়ন হয়। বাংলাবিদে যে ছেলে–মেয়েটি ভালো করে, সে বলে, আমি ছোটবেলা থেকেই কিআ পড়ি। সেখান থেকে বানান আর ভাষার প্রতি আমি ভালোবাসা অর্জন করেছি। একজন অভিভাবক একদিন তাঁর সন্তানকে কিআর মাসিক বৈঠকে এনে বলেছিলেন, ‘আমার বাচ্চাটার একটা রোগ আছে। এটা সারবে না। ও মন খারাপ করে থাকে। এখানে এসে ও যদি সবার সঙ্গে মেশে, ওর ভালো লাগতে পারে। আমি বাচ্চাটাকে আগে দেখতাম মনমরা, এখন কত যে হাসিখুশি, সবার সঙ্গে ছুটছে, খেলছে, কাজ করছে।’

যেখানেই যাই, কিআর পাঠকেরা আসে, আমাকে ঘিরে ধরে। আমি জানি, ওরা লেখাপড়ায় ভালো, খেলাধুলায় উৎসাহী, সংস্কৃতিচর্চা করে, স্বেচ্ছাসেবা করে, ওরা মানুষ হবে, দেশকে পাল্টে দেবে, জগৎটাকে আলোকিত করবে।

কিশোর আলোর ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সবাইকে জানাই ভালোবাসা, অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা।

এখন শিরোনামের প্রশ্নের জবাব। আইনস্টাইন কি কিশোর আলো পড়ছেন? স্টিফেন হকিংকে এক আসরে এক কিশোর জিজ্ঞেস করেছিল, এটা কি হতে পারে, অন্য সমান্তরাল পৃথিবীতে গায়ক জায়ান মালিক বিখ্যাত ব্যান্ডদল ‘ওয়ান ডিরেকশন’ ছেড়ে যায়নি? 

হকিং বলেছিলেন, হ্যাঁ। অন্য জগতে ‘ওয়ান ডিরেকশন’ আছে, তাতে জায়ান মালিক এখনো তাঁর ব্যান্ড ছেড়ে যাননি।

অন্য জগতে বসে আইনস্টাইন নিশ্চয়ই তাঁর ছেলেবেলায় সেখানকার কিশোর আলো পড়ছেন।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক