ব্যক্তি নয়, দায়ী সংগঠন ও পদ

সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা, এমনকি সমর্থকেরা পর্যন্ত চিরকাল সব দেশে সরকারি সুযোগসুবিধা বেশি ভোগ করেন। মানুষ এটাকে স্বাভাবিক প্রথা হিসেবেই মেনে নিয়েছে। সেকালে অবিভক্ত বাংলার তিন প্রধানমন্ত্রী—ফজলুল হক, নাজিমুদ্দিন ও সোহরাওয়ার্দী তাঁদের নিজেদের লোকদের চাকরি দিয়েছেন অন্য দলের অপেক্ষাকৃত যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও। মানুষ তাতে তেমন কিছু মনে করেনি। ১৯৫৫-৫৮ সময়ে আওয়ামী লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টি চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করেছে। মুসলিম লীগপন্থীরা সুবিধা করতে পারেননি, যে সুবিধা তাঁরা ১৯৪৭ থেকে ৫৪ পর্যন্ত পেয়েছিলেন। 

কিছু সরকারি আনুকূল্য বেশি পাওয়া আর দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে রাষ্ট্রকে শুষে ছোবড়া বানিয়ে দেওয়া এক জিনিস নয়। ভোগবাদ একটি সংক্রামক জিনিস। ভোগবাদের স্পৃহা একজনকে দেখে আরেকজনের মধ্যে জেগে ওঠে এবং শুধু জেগে ওঠে না, আরও বেশি ভোগের আকাঙ্ক্ষা জাগে। অন্যদিকে কৃচ্ছ্রব্রত ও নীতিপরায়ণতা সাধনাসাপেক্ষ। এখন দুর্মূল্যের বাজার। তবু একজন উচ্চ মধ্যবিত্তের অত্যন্ত বিলাসী জীবন যাপন করতে কী পরিমাণ টাকার দরকার? কতটা সম্পদ তাঁর নিজের ও বংশধরদের জন্য প্রয়োজন? 

১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলোপের আগপর্যন্ত বাংলার বড় জমিদারেরা প্রজাদের শোষণ করে খুবই বিলাসী জীবন যাপন করেছেন। তা করার ভেতরে মানুষ কোনো অস্বাভাবিকতা দেখতে পায়নি। তাঁদের বিলাসী জীবনযাপন সাধারণ মানুষের মধ্যে সমীহ সৃষ্টি করেছে। তাঁদের প্রতি মানুষের ঘৃণার উদ্রেক করেনি। 

বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে একটি দেশে প্রধান দল দু-তিনটি থাকে। সেসব দলে সব বয়সী নেতা-কর্মী থাকেন। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত থেকে শুরু করে অতি বৃদ্ধ পর্যন্ত। বাংলাদেশেও বড় দলগুলোর অঙ্গসংগঠন রয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রসংগঠন, কৃষক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন। পেশাজীবী সংগঠনগুলো দলের স্বার্থে শ্রেণি-পেশাজীবীদের মধ্যে কাজ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে যে যুব সম্প্রদায়, তাদের জন্য দলের দরজা খোলা। দলের নেতা-কর্মী হিসেবে কাজ করতে তাদের বাধা নেই। তাদের জন্য আলাদা একটি সংগঠন গড়ে তোলার উপযোগিতা কী? 

মানবজীবনের কয়েকটি ভাগ রয়েছে। একেবারে প্রথমটি শৈশব—১০-১২ বছর পর্যন্ত। আর একটি সংক্ষিপ্ত পর্যায় রয়েছে, সেটা কৈশোর—১২ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত। যুবা বয়স ১৬ থেকে সর্বোচ্চ ৪০। চল্লিশের ওপরে যাঁরা, তাঁদের যুব হিসেবে গণ্য করা যায় না। বছর দুই আগে পদ্মার এক ঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কয়েকজন বলিষ্ঠদেহী মানুষ কী নিয়ে জটলা করছিলেন। তাঁদের একজন মধ্যবয়সী নিজেই এগিয়ে এসে পরিচয় দিলেন, আমি জেলা যুব অমুক সংগঠনের অমুক। ক্ষমতাশালী পদ। একজনকে হুকুম দিলেন, যা, স্যারের জন্য চা-বিস্কুট নিয়ে আয়। চা-কে আপত্তি বলায়, তা অইলে ডাব আন। 

যুবনেতার বয়স পঞ্চাশের মতো। মাথায় টাক পড়ার উপক্রম। মানানসই ভুঁড়ি। ছেলেমেয়ে কলেজে পড়লেও পড়তে পারে। দেখে বোঝা যায় একজন প্রতিষ্ঠিত বিত্তবান মানুষ। তাঁর পক্ষে মূল দলের নেতা হলেই স্বাভাবিক হতো। তিনি যদি যুব সংগঠনের নেতা হন, প্রকৃত যুবরা যাবেন কোথায়? ৩০-৩৫ বছর বয়সী যুবাদের কচি–কাঁচারা সরে যাওয়া ছাড়া উপায় কী? 

ওই প্রবীণ ব্যক্তি যে যুব সংগঠনের নেতা, সেই সংগঠন যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৭২ সালে, তখন তাঁর বয়স ছিল ৩২। যুব সংগঠন গড়ার সে-ই উপযুক্ত বয়স। তখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার বয়স ছিল ৫২ বছর। তখন আমাদের অর্থমন্ত্রীর বয়স ছিল ৪৭ বছর। তখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছিলেন যেসব নেতা ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, তাঁদের প্রায় সবারই বয়স ছিল ৩৫ থেকে ৫০-এর মধ্যে। এটাই গঠনমূলক কাজ করার শ্রেষ্ঠ সময়। ৬০, ৭০, ৮০-তে মানুষের পরিশ্রম করার ক্ষমতা কমে যায়। মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন, মৃত্যুর পরোয়া করেননি, তাঁরা প্রায় সবাই ১৫ থেকে ৪০-এর কোঠায় ছিলেন। 

আমরা শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে মুক্তিযুদ্ধ করলেও স্বাধীনতার পর থেকে যে ধারায় চলতে শুরু করি, তাতে ওই অঙ্গীকার অর্থহীন হয়ে পড়ে। শাসকশ্রেণির পছন্দমতো ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নতুন নতুন সংগঠনের প্রয়োজন হয়। সংগঠন ছাড়া ব্যক্তি শক্তিশালী হতে পারে না। সংগঠনের নীতি, আদর্শ কোনো ব্যাপার নয়, থাকতে হবে পেশিবল। সেই পেশিবল দলকে শক্তিশালী করে শারীরিক দিক থেকে, কিন্তু দলকে বিপদে রক্ষা করতে পারে না; বরং বিপদের মধ্যে, দুর্দিনে সংগঠন ও সংগঠনের পরাক্রমশালী নেতাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। সেটা আমরা দেখেছি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরে, দেখেছি যখন সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হয়ে কারারুদ্ধ হলেন। তখন ছাত্র ও যুবদের বাহুবলের কোনো পরিচয় পাওয়া গেল না। ২০০৯-এ সরকার গঠনের পরই ছাত্র-যুব সংগঠনের নেতাদের প্রবল শক্তির প্রকাশ ঘটে। 

সংগঠনের নেতাদের ব্যক্তি হিসেবে মূল্য নেই। একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে যে ছাত্রনেতারা ‘ঈদের সালামি’ হিসেবে কোটি দুয়েক টাকা নেন, বা উপাচার্যের কাছে উন্নয়নকাজের ৪ থেকে ৬ ভাগ দাবি করেন, সেখানে ব্যক্তির কোনো দাম নেই। ওই নেতারা যদি সংগঠনের বড় পদে না থাকতেন, তাহলে উপাচার্যের কাছে মিঠাই মণ্ডা খাওয়ার জন্য হাজার দুই টাকা চাইলেও পেতেন না। আসলে ব্যাপার হলো পদ। 

উপাচার্য একটি পদ। যে পদের একজনের উন্নয়ন প্রকল্পে টাকা ব্যয় করার ক্ষমতা রয়েছে। হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার ক্ষমতা যদি উপাচার্যের না থেকে অন্য কোনো সংস্থার থাকত, তাহলে উপাচার্যের ড্রয়িংরুমে কোনো ছাত্র পদধূলি দিতেন না। সুতরাং, দোষটা ব্যক্তি উপাচার্যের নয়, ব্যবস্থার। বিদ্যমান ব্যবস্থায় যিনি উপাচার্যের চেয়ারে বসবেন, তাঁকেই ঈদের সালামি হোক বা ছাত্রনেতার ম্যারেজ ডের অনুষ্ঠান উপলক্ষে হোক, সালামি দিতেই হবে। 

যে ছাত্র-যুবনেতারা বিচিত্র সূত্র থেকে সালামি নিয়ে থাকেন, তাঁরা ব্যক্তি হিসেবে কেউ কিছু নন। হাসন রাজার ভাষায় বলতে গেলে তাঁরা বলতে পারেন, ‘আমি কিছু নয় রে, আমি কিছু নয়’। সবই পদের মহিমা। সে জন্য বেশি বেশি সংগঠন বানাতে হয়। চড়া দামে পদ বিক্রিও হয়। 

ছাত্রসংগঠনের সর্বোচ্চ পদ যদি জনাব ‘ক’-এর না হয়ে ‘খ’ বা ‘গ’-এর হতো, সালামি দাবিদার তিনি হতেন। যে নেতাদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা যদি আবার উপাচার্যের কাছে চাঁদা দাবি করতে যান, ধারণা করি কিছুই পাবেন না। রাষ্ট্রের যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা না ভাঙা হলে মানুষগুলোকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সমাজের কোনো উপকার হবে না। সংগঠন আছে বলেই পদ আছে, পদ আছে বলেই চাঁদাবাজি আছে, ক্যাসিনো খেলা আছে, হাজার হাজার কোটি কালোটাকা আছে, হাজার হাজার ভরি স্বর্ণ আছে, নামে-বেনামে ফ্ল্যাট ও জমি আছে। 

কোন পদ ব্যবহার করে কোন নেতা কোথায় কী করছেন, তা মূল দলের নেতাদের অজানা থাকার কথা নয়। কারও আচরণ সন্দেহজনক হলে দল থেকে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। বহিষ্কার করা যায়। প্রশাসনকে দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া দলের জন্য মানহানিকর। মূল দল যদি মনে করে অঙ্গসংগঠনের কিছু কিছু নেতা খুব বেড়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের প্রতিহত করা যাচ্ছিল না, সুতরাং তাঁদের ডানা কিছুটা ছেঁটে দেওয়া দরকার। সে জন্য শুদ্ধি অভিযান। তাতে সার্বিক অবস্থার উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। 

সত্যিকারের যুবসমাজ পৃথিবীতে পরিবর্তন ঘটাতে পারে। বাংলাদেশেও রয়েছে বিশাল যুবশক্তি। তাদের নিষ্ক্রিয় রেখে বয়োবৃদ্ধ যুবনেতারা জাতিকে প্রাণহীন অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারবেন, কিছু দিতে পারবেন না। দু-তিন সপ্তাহ ধরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ও অস্ট্রেলিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির বিরুদ্ধে লাখ লাখ যুবক-যুবতী রাজপথে আন্দোলন করছেন। আমাদের যুব সংগঠনগুলোর বৃদ্ধ নেতারা ১০ জন মানুষ নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াননি। বড় প্রকল্পের কাজের টেন্ডার নিয়ে কামড়াকামড়ি, বিরোধী দলের জনসভায় যোগদানকারী কর্মীদের বাসের গতি রোধ করার মধ্যে যুবসমাজের শক্তির প্রকাশ নয়। বসবাসযোগ্য সুন্দর অবদান রাখতে অক্ষম যেসব যুব সংগঠন, সেগুলো বিলুপ্ত করাই জাতির জন্য কল্যাণকর। 

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক