যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষার যুক্তি শুধু তিস্তায়

নিউইয়র্কে গত শুক্রবার বৈঠকে বসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
নিউইয়র্কে গত শুক্রবার বৈঠকে বসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরের দিন কয়েক আগে, গত ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের তরফে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে এক দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। দুই দেশের সম্পর্ক কত মজবুত, দুই দেশ কীভাবে কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একে অন্যের অভিন্নহৃদয় সুহৃদ হয়ে উঠেছে, পারস্পরিক উচ্চপর্যায়ের সফর কেমনভাবে সম্পর্ককে একের পর এক উচ্চ সোপান পেরোতে সাহায্য করেছে, এই প্রতিবেদনে তার সবিস্তার উল্লেখ রয়েছে। নিরাপত্তা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও লগ্নি, বিদ্যুৎ-শক্তি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহযোগিতার স্বরূপ, যোগাযোগের বহরের বিস্তার, বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষণ শিবির, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং ভিসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো সবিস্তারে বলা হয়েছে।

হাসিনার সফরের আগে দীর্ঘ ছয় পৃষ্ঠার এই ‘ব্যাকগ্রাউন্ড পেপারের’ উল্লেখ করার একমাত্র কারণ, দুই দেশের মধ্যে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে তাতে খরচ হয়েছে মাত্র ৯০টি শব্দ। এবং সেই শব্দগুলোর মধ্যে বিস্ময়জনকভাবে অনুপস্থিত ‘তিস্তা’। এই সফরে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে তেমন ইতিবাচক কিছু আশা করা যে ঠিক হবে না, সে কথাই কি এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট করা হলো? জানানো হলো, তিস্তার পানিবণ্টন আহামরি কোনো দ্বিপক্ষীয় বিষয় নয়? তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ হলো বাণিজ্য, যোগাযোগ, লগ্নি, নিরাপত্তা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা? কী জানি। হতে পারে। কিংবা হয়তো নয়। কূটনীতিতে নানান স্তর থাকে। নানা শব্দ বহুভাবে ইঙ্গিতবাহী হয়ে ওঠে। শব্দচয়নের মধ্য দিয়ে অনেক কিছু বলা অথবা না-বলা হয়। অনেক কিছু অনেকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ‘তিস্তা’ অনুচ্চারিত রেখে সেটাই করা হলো কি না, সে কথাই ভেবে চলেছি।

এ ভাবনার মধ্যেই এসে পড়ল নিউইয়র্ক থেকে পাঠানো বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) প্রতিবেদন। জাতিসংঘের আসরের অবসরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক প্রসঙ্গে বাসস লিখেছে, এনআরসি ও তিস্তার মতো অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এনআরসি নিয়ে হাসিনা তাঁর উদ্বেগের কথা জানালে নরেন্দ্র মোদি তাঁকে বলেন, ‘এনআরসি ও পানিবণ্টনের মতো ইস্যুগুলোকে আমরা সহজভাবে নিতে পারি। কারণ, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের এই উদ্ধৃতির উল্লেখ করে বাসস জানিয়েছে, ৫ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।

মজার বিষয়, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৭ সেপ্টেম্বর ওই বৈঠক নিয়ে যে বিবৃতি প্রচার করে, তাতে এনআরসি নিয়ে হাসিনার উদ্বেগ ও তিস্তার পানিবণ্টন-সংক্রান্ত হতাশা বা প্রত্যাশা নিয়ে একটি শব্দও নেই। এটি কী প্রমাণ করে জানা নেই। তাহলে কি ধরে নিতে হবে, তিস্তা নিয়ে আশ্বাস আদায় ছাড়া এই সফরেও বাংলাদেশের বাড়তি কিছু পাওয়ার নেই?

দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে ৫ অক্টোবরের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে হাসিনা এনআরসি নিয়ে আরও একবার আনুষ্ঠানিক উদ্বেগ প্রকাশ করলে অনুমান করা যায়, মোদি নতুনভাবে তাঁকে আশ্বস্ত করে নিউইয়র্কে বলা কথাটাই আরও একবার শোনাবেন। কারণ, ওটাই ভারতের ঘোষিত নীতি, যা এই কদিন আগে ঢাকায় গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলে এসেছেন। অর্থাৎ, এনআরসি ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার কারণ নেই।’ একই রকম, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির প্রসঙ্গ উঠলেও অনুমান করা যায়, ক্ষমতায় আসার পর থেকে নরেন্দ্র মোদি যে কথা শুনিয়ে আসছেন, এবারও সে কথা বলে হাসিনাকে আশ্বস্ত করবেন। বলবেন, মমতা দিদিকে বোঝানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষার বাধ্যবাধকতার কথা শুনিয়ে বলতে পারেন, দেশের অঙ্গরাজ্য রাজি না হলে একতরফা চুক্তি করা কঠিন। অভিন্ন ৫৪ নদীর পানিবণ্টন ও অববাহিকা ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে বলতে পারেন, যৌথ নদী কমিশন বিষয়টি বিবেচনা করছে। মোট কথা, তিস্তা নিয়ে এক তরফের আশ্বাসবাণী ও অন্য তরফের তা শোনা ছাড়া বাড়তি কিছু পাওয়ার আশা বাংলাদেশ সম্ভবত করছে না। অন্তত তেমন কোনো ইঙ্গিত এখনো নেই।

অথচ প্রথম পাঁচ বছরে তো বটেই, দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যাটিং যেন আরও বেশি বিধ্বংসী, আরও মারকাটারি। ঠিক যেন মধ্যগগনের ভিভ রিচার্ডস কিংবা বীরেন্দর শেবাগ। ধ্রুপদি, কেতাদুরস্ত অথচ ব্যাকরণ ভাঙা ব্যতিক্রমী। যেভাবে কাকপক্ষীকে টের পেতে না দিয়ে তিনি কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা কেড়ে নিলেন, একটা পূর্ণ রাজ্যকে দুভাগ করে জন্ম দিলেন দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের, ‘এক বিধান, এক নিশান, এক প্রধান’-এর স্বপ্ন সাকার করলেন, এক কথায় তা অকল্পনীয়! এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষার কোনো প্রয়োজনীয়তা কিন্তু অনুভূত হয়নি। অনুভূত হয়নি গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় রীতিনীতি পালনের তাগিদও। সংবিধান সংশোধন বিল সংসদে পেশ করতে হয় অন্তত দুদিন আগে, যাতে সাংসদেরা বিলটি ভালোভাবে পড়ে উঠতে পারেন। জরুরি ভিত্তিতে দিনের দিন এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিল পেশ করার অনুমতিদানের ক্ষমতা সংসদের উভয় কক্ষের অধ্যক্ষের রয়েছে। এই প্রথমবার সে ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল পেশ করা হলো। দুদিন তো দূরের কথা, বিল অনুধাবনে দুই ঘণ্টা সময়ও সাংসদদের দেওয়া হলো না।

যে রাজ্যকে টুকরো করা হচ্ছে, যে রাজ্যের সংবিধানপ্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতা প্রত্যাহৃত হচ্ছে, যে রাজ্যের অধিবাসীদের ‘মঙ্গলের জন্য’ এসব করা হচ্ছে, সেই রাজ্যের বাসিন্দাদের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনার প্রয়োজনও বোধ করেনি কেন্দ্রীয় সরকার। গোটা রাজ্যকে গৃহবন্দী করে, কারও তোয়াক্কা না করে সিদ্ধান্তটা কার্যকর করা হলো! তথ্য জানার অধিকার (আরটিআই) আইন সংশোধনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্র ও রাজ্যের তথ্য কমিশনের প্রধান ও তার সদস্যদের নিযুক্তির মেয়াদ ও বেতনকাঠামো নির্ধারণের ক্ষমতা হাতে নিল। সংশোধন করা হলো বেআইনি কাজকর্ম প্রতিরোধ আইন, যা কিনা ‘ইউএপিএ’ নামে পরিচিত। সন্ত্রাস দমনে এই আইন এমনিতেই যথেষ্ট কঠোর। সংশোধনের মধ্য দিয়ে সরকার এবার থেকে যেকোনো ব্যক্তিকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দিয়ে তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। বিনা বিচারে আটকে রাখতে পারবে।

বিরোধীদের প্রবল আপত্তি সরকার কানে তোলেনি। আরও বিবেচনার জন্য স্ট্যান্ডিং কমিটি বা সিলেক্ট কমিটিতে পাঠাতেও রাজি হয়নি। দ্বিতীয় দফায় সংসদে যতগুলো বিল পাস হয়েছে, একটিও আরও গভীর বিবেচনার জন্য সরকার অপেক্ষায় রাজি হয়নি। জম্মু-কাশ্মীর পরিস্থিতি, তিন তালাক বিল, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কিংবা এনআরসি তৈরির প্রস্তাব, সর্বভারতীয় কোনো বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টায় আজ পর্যন্ত একবারের জন্যও সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার প্রয়োজন বোধ করেনি সরকার। পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাজের পদ্ধতিগত কিছু মাপকাঠি আচমকাই বদলে দিয়েছে। রাজ্যগুলোর সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা না করেই। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো উপেক্ষা করার’ মারাত্মক অভিযোগ আনলেন। প্রধানমন্ত্রী কর্ণপাত করলেন না। বারবার বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাঁর ইচ্ছাই প্রথম ও শেষ কথা। মোদি চাইছেন অথচ তা বলবৎ হচ্ছে না—এমন একটি উদাহরণও এই পাঁচ বছর সোয়া শ দিনে পাওয়া যাবে না। সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম তিস্তা!

তিস্তা চুক্তি রূপায়ণের প্রশ্ন কবে থেকে ঝুলে রয়েছে, তা সবার জানা। মনমোহন সিং কেন ব্যর্থ, তা যেমন জানা, নরেন্দ্র মোদি কোন যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশকে অপেক্ষায় রেখেছেন, তা–ও জানা। একমাত্র এ ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষার বাধ্যবাধকতা বারবার প্রবলভাবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে! পাঁচ বছর সোয়া শ দিনের নরেন্দ্র মোদির দেশ শাসনের স্টাইল ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে চারিত্রিক দৃঢ়তার প্রদর্শনের পাশে এই যুক্তি বাংলাদেশের কাছে নিতান্ত বেমানান লাগতেই পারে। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আরও একবার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আসরে বসে শেখ হাসিনা নিশ্চিতই এই বৈপরীত্যকে বড় করে তুলে ধরবেন না। সুপ্রতিবেশী কোনো বন্ধু তা করেও না। কিন্তু যুক্তিটা যে খচখচ করবে না, জোর দিয়ে কি বলা যায়?

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি