সবাইকে নিয়েই চীনকে এগোতে হবে

চীনে গণপ্রজাতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পূরণ হয়েছে। ছবি: এএফপি
চীনে গণপ্রজাতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পূরণ হয়েছে। ছবি: এএফপি

চীনে গণপ্রজাতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর (গতকাল ১ অক্টোবর) পূরণ হলো। নানা ধরনের জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিষয়টিকে উদ্‌যাপন করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে দেশটিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঊর্ধ্বতন চীনা কর্মকর্তা ও বিদেশি কূটনীতিকদের অংশগ্রহণে নৈশভোজ হচ্ছে। তিয়েনআনমেন স্কয়ারে বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজ হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে চীনা নেতাদের সম্পর্ক উত্তেজনাকর হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় চীন সরকার তার নাগরিকদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলার একটা মোক্ষম উপলক্ষ পেয়েছে। তবে এ সাফল্য উদ্‌যাপন দেশটির ঘাড়ে আরও অনেক বেশি দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। 

 ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’খ্যাত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রম এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে সামনে এনে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) শাসনের প্রথম ৩০ বছরকে সাধারণত খুব অন্যায্যভাবে মূল্যায়ন করা হয়। অনেকেই ভুলে যান, এগুলো একেবারে নিষ্ফলা ও হারিয়ে যাওয়া দশক নয়। ওই তিন দশকেই চীনকে আধুনিক হিসেবে গড়ে তোলার মূল কাজগুলো করা হয়েছিল। ওই তিন দশকেই স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিদ্যুৎ গ্রিড প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সময়টাতেই জনসম্পদ দ্রুতগতিতে সমৃদ্ধ হয়েছিল। 

গত ৭০ বছরে চীনের মানবসম্পদ উন্নয়নের সূচক ঊর্ধ্বমুখী থেকেছে। ১৯৪৯ সালে দেশটিতে সাক্ষরতার হার ছিল ২০ শতাংশের নিচে। ১৯৭৯ সালে তা ৬৬ শতাংশে উঠে আসে। এই সময়কালে গড় আয়ু ৪১ বছর থেকে ৬৪ বছরে উন্নীত হয়। দেং জিয়াওপিংয়ের ‘রিফর্ম অ্যান্ড ওপেনিংআপ’ প্রোগ্রামের বদৌলতেই এই অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হয়। গত ৪০ বছরে চীনের ঝোড়োগতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল ভিত্তিই ছিল এই প্রোগ্রাম। 

বর্তমানে চীনের ‘টু-ডু লিস্ট’ বা করণীয় তালিকা বেশ লম্বা। তবে দেশটির নেতারা সেই লম্বা তালিকা থেকে তাঁদের অগ্রাধিকারমূলক করণীয় বেছে নিচ্ছেন। এর মধ্যে জনগণের অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো এবং পরিবেশের ক্ষতি না করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপ্তি বাড়ানোকেই তাঁরা প্রধান অ্যাজেন্ডা হিসেবে নিয়েছেন। এতে যদি তাঁরা সফল হন, তাহলে চীনের উন্নয়ন মডেল নিঃসন্দেহে পশ্চিমা ঘরানার উদার গণতান্ত্রিক উন্নয়ন মডেলের আদর্শ বিকল্প হিসেবে টিকে যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে সফল হতে হলে আগামী দিনগুলোতে তঁাদের দুটি বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে। 

প্রথমত, চীনকে উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদায় পৌঁছাতে হবে। চীন আয় বাড়ানোর জন্য তার বিশাল বাজার ও বিশাল উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। এই বিশাল বাজারে পণ্য সরবরাহ করে চীনের বার্ষিক মাথাপিছু আয় হয় ১০ হাজার ডলার। এই আয় ৩০ হাজার ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে দেশটি কাজ করে যাচ্ছে। সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে প্রযুক্তি খাতে তাকে আরও অনেক বেশি সৃজনশীল হয়ে এগোতে হবে। 

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো এই সাফল্যে পৌঁছাতে হলে চীনকে অবশ্যই বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) সাফল্য নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশগত দিক থেকে টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ ও আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সাফল্য আসতে পারে। 

এই দুটির কোনোটিই অর্জন করা সহজ হবে না। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠার কারণে তাকে অনেক বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। প্রযুক্তি ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে হুমকি হিসেবে দেখছে। যখন বিশালাকৃতির কোনো জাহাজ যাত্রা শুরু করে, তখন জাহাজের ক্যাপ্টেন যত সতর্ক হয়েই জাহাজটি চালান, জাহাজের ঢেউ আশপাশের অন্য নৌযানে লাগবেই। চীন সেই ধরনের বিশাল জাহাজের মতোই তার যাত্রা শুরু করেছে। এ অবস্থায় তার চারপাশের দেশগুলোকে শান্ত রাখতে হবে। এ জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তাকে উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। তবে এটিও ঠিক যে সব দায় চীনের ওপর চাপানো ঠিক হবে না। পশ্চিমা নেতাদেরও চীনের এই অগ্রযাত্রাকে স্বাগত জানানো উচিত। 

১৯৯৯ সালে বেলগ্রেডে চীনা দূতাবাসে ন্যাটো বোমা হামলা চালানোর ঘটনা কিংবা ২০১১ সালে হাইনান দ্বীপের কাছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের এয়ারক্র্যাফটের সংঘর্ষের ঘটনার শান্তিপূর্ণ সুরাহা হয়েছিল। আলোচনার মধ্য দিয়েই সেসব উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছিল। সিপিসির শাসনের ৭০ বছর উদ্‌যাপনের সময় চীনকে এই আলোচনার নীতিতেই অবিচল থাকতে হবে। দেশটিকে বুঝতে হবে তারা যে যাত্রা শুরু করেছে, তা সফল করতে হলে পশ্চিমাদের খেপিয়ে তুলে তা করা কঠিন হবে। 

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
কিউ জিন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক