ব্যক্তি উদ্যোগে বয়স্ক ভাতা

নোবেলজয়ী আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস ৬১ বছর বয়সে ‘সেইলিং টু বাইজান্টিয়াম’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। উত্তম পুরুষে লেখা এই কবিতায় একটি কল্পিত বৃদ্ধ চরিত্রের মধ্য দিয়ে ইয়েটস বলেছিলেন, তাঁর নিজের দেশ তরুণ প্রজন্মের দাবি ও সমস্যা নিরসনে অতিশয় ব্যস্ত এবং তারা ভোগবিলাসী যৌবনোন্মাদনায় মোহগ্রস্ত। যেহেতু তাঁর দেশে সম্মানিত প্রবীণেরা উপেক্ষিত ও অবহেলিত, সেহেতু সে দেশে তিনি আর থাকতে চান না। সে কারণে তিনি ‘বাইজান্টিয়াম’ (আজকের ইস্তাম্বুল) নগরে পাড়ি জমাচ্ছেন, যেখানে বৃদ্ধরা তাঁদের প্রাপ্য সম্মান পান। 

খাগড়াছড়ির দীঘিনালার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী চঞ্চলকান্তি চাকমারও বয়স এখন ৬১ বছর। তিনি এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তিনি হয়তো ইয়েটসের এই জগদ্বিখ্যাত কবিতাটি পড়েননি। তবে ৬১ বছর বয়সে প্রবীণদের নিয়ে ইয়েটসের উপলব্ধির জগতে যে আন্দোলন হয়েছিল, ঠিক একই বয়সে এসে একই আন্দোলন চঞ্চলকান্তির মনোজগতে ঘটে গেছে। 

হতদরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া চঞ্চলকান্তি গত বছর রাঙামাটি জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষক পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। এখন তিনি অবসর ভাতা পাচ্ছেন ১২ হাজার টাকা। সেই সম্বল নিয়েই তিনি ব্যক্তি উদ্যোগে বয়স্ক ভাতা চালু করেছেন। 

গত মঙ্গলবার বিশ্ব প্রবীণ দিবসে চারজন নারী ও একজন পুরুষকে মাসিক ৫০০ টাকা হারে দেওয়ার মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু করেছেন তিনি। ওই দিন সকালে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঁচজনের হাতে বয়স্ক ভাতার বই ও অক্টোবর মাসের টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে। তার মানে প্রতি মাসে নিজের অবসর ভাতার ১২ হাজার টাকা থেকে তিনি আড়াই হাজার টাকা আরও পাঁচজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার হাতে আজীবন তুলে দিয়ে যাবেন। 

চঞ্চলকান্তি চাকমা বলেছেন, ‘আপাতত পাঁচজনকে সারা জীবন মাসিক ৫০০ টাকা করে দেওয়া হবে। আমার আর্থিক অবস্থা ভালো হলে আরও বয়স্ক ব্যক্তিকে এতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’ 

দেশের সচ্ছল নেতা ও কর্মকর্তাদের বিরাট একটি অংশের অর্থনৈতিক আচরণ যখন প্রশ্নবিদ্ধ, ইয়েটসের কবিতা গুলে খাওয়া বিদ্বজ্জনদের অনেকের বৃদ্ধ মা–বাবা যখন চরম অবহেলায় ধুঁকে ধুঁকে মরছেন, সে মুহূর্তে চঞ্চলকান্তি চাকমার এই উদ্যোগকে প্রশংসা করার মতো ভাষা সহজলভ্য নয়। প্রতিবছরই বিশ্ব প্রবীণ দিবস আসছে, আর বিজ্ঞজনেরা বাণী দিয়ে যাচ্ছেন। আর প্রবীণেরা যে তিমিরে, সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছেন। 

বিভিন্ন সংগঠনের বিগত ১০ বছরের ‘বাণী-বার্তা’গুলোতে চোখ রাখলে দেখা যাবে, সেখানেও প্রবীণদের নিয়ে একই কথা ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে বলা হচ্ছে। কিন্তু তা রূপায়ণের যথার্থ পদক্ষেপ নেই। চঞ্চলকান্তি চাকমার উদ্যোগ দেখে তাঁরাসহ সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক। প্রবীণেরা তাঁদের অধিকার ফিরে পাক।