বিভক্তি পেছনে ফেলে এগোচ্ছে এক জার্মানি

কিছু বৈষম্য, কিছু অসন্তোষ, কট্টরবাদীদের আস্ফালন থাকলেও জার্মানি এগোচ্ছে। ছবি: রয়টার্স
কিছু বৈষম্য, কিছু অসন্তোষ, কট্টরবাদীদের আস্ফালন থাকলেও জার্মানি এগোচ্ছে। ছবি: রয়টার্স

অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জার্মানি এগিয়ে যাচ্ছে বটে, তবে একটি অভ্যন্তরীণ বিতর্ক দেশটির রাজনীতির পিছু ছাড়েনি। বিষয়টি হলো, জার্মানির পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত। ২৯ বছর আগে পূর্ব জার্মানির জনসাধারণ সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে অধিক গণতন্ত্রের দাবিতে এক বছরের মাথায় দেশটির পশ্চিমাঞ্চল বা পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য মরিয়া হয়েছিল। তবে এখন তাদের নানা অগণতান্ত্রিক আচরণ সেখানে গণতন্ত্রের ধারণা নিয়ে সংশয় তৈরি করেছে।

জার্মানি যখন ইউরোপীয় ঐক্য, তথা বিশ্বরাজনীতিতে নিজেদের প্রজ্ঞা ও দক্ষতা দিয়ে জার্মান জাতির নতুন ভাবমূর্তি নির্মাণে ব্যস্ত, তখন সেই প্রগতির চাকাকে পেছনে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। একটি দেশের রাজনীতি এবং রাজনীতিকেরাই সবকিছুর পরিবর্তন ঘটাতে পারেন না, জনগণকেও পরিবর্তিত হতে হয়, সহযোগিতা থাকতে হয়। অথচ সাবেক পূর্ব জার্মানির অনেক মানুষ একসময় পরিবর্তন চাইলেও এখন তা আর আত্মস্থ করতে পারছে না।

দুই বছর আগে জার্মানির ১৯তম সাধারণ নির্বাচনে পূর্বাঞ্চলের ১২ শতাংশ ভোটার জার্মানির মূলধারার দলগুলোকে সমর্থন না দিয়ে কট্টরবাদী অলটারনেটিভ ফর জার্মানি দলটিকে ভোট দিয়েছেন। পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে সাক্সেনে আবার ৪৭ শতাংশ ভোটার কট্টর জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। জার্মানির পার্লামেন্ট বা বুন্ডেশটাগে জোট সরকারের বিপরীতে কট্টরবাদী দলটি ৯১ আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দল। পূর্বাঞ্চলে গত ২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত দুটি রাজ্য পার্লামেন্ট নির্বাচনেও কট্টরবাদী দলটি ব্রান্ডেনবুর্গে ২৩ শতাংশ এবং সাক্সেন রাজ্যে ২৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে। রাজ্য দুটিতে সরকার গঠন করতে না পারলেও তারা পার্লামেন্ট দুটিতে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা রাখবে।

খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার, দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ১৯৪৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণায় লালিত হওয়া দেশটির মানুষ এখন আবার রক্ষণশীল বর্ণবাদী দলের সমর্থক হচ্ছেন এবং তাদের ভোট দিচ্ছেন।

জার্মানির পূর্বাঞ্চলের নাগরিকদের এই আচরণ ও মনস্তাত্ত্বিক ধারণা নিয়ে বার্লিনে বসবাসরত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং জার্মানি ও ইউরোপ স্টাডিজ বইয়ের লেখক আলেক্সান্ডার ক্লার্ক বলেছেন, জার্মানির পূর্বাঞ্চলের মানুষের মধ্যে যে সমস্যাগুলো, তা অনেকটাই ভ্রম বা একধরনের মায়ার জাল। তিনি বলেছেন, ১৯৮৯ সালে দুই জার্মানির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়ার প্রাক্কালে তৎকালীন জার্মানির চ্যান্সেলর হেলমুট কোল বলেছিলেন, ঐক্যবদ্ধ জার্মানিতে অচিরেই জার্মানির পূর্বাংশ অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে দেশটির পশ্চিমাংশের মতো হবে। বিষয়টি পূর্বের মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। তবে সব পরিবর্তন যে শিগগিরই ঘটে না, তা তারা অনুধাবন করতে পারছে না।

প্রায় চার দশক ধরে পূর্ব জার্মানির মানুষ ছিল সমাজতান্ত্রিক নিয়মনীতির কড়া শাসনে আবদ্ধ। তারা নিজেদের মুক্ত করতে চেয়েছিল, পশ্চিমা গণতন্ত্রের স্বাদ পেতে সম্পৃক্ত হতে মিছিল সমাবেশ করেছিল। ১৯৮৯ সালে নিজেদের মুক্ত করতে দেশ ত্যাগ করে ৫০ হাজার মানুষ হাঙ্গেরি আর অস্ট্রিয়ায় গিয়ে শরণার্থী হয়েছিল। দীর্ঘ সময় পূর্ব জার্মানি মার্ক্সবাদী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চালিত হলেও দেশটির জনগণের কোনো গণতান্ত্রিক অধিকার, বাক্‌স্বাধীনতা বা অনেক সামাজিক অধিকার ছিল না। ঐক্যবদ্ধ জার্মানিতে তারা গণতান্ত্রিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার পেলেও অনেক ক্ষেত্রেই অতৃপ্তি রয়ে যায়। পূর্বাঞ্চলের নতুন প্রজন্মের অনেক নাগরিকও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সেই বিশ্বাসকে ধারণ করছে।

প্রায় ৪০ বছর ধরে দুই বিপরীতধর্মী সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে এক করে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি সহজ ছিল না। পূর্ব জার্মানিতে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে বা ভর্তুকিচালিত অধিকাংশ কলকারখানা বন্ধ হয়েছিল। শ্রমিক-কর্মচারীদের কোনো রকম সহানুভূতি না দেখিয়ে ছাঁটাই করা হয়েছিল। অর্থনীতির ভাষায় বলা যায়, এটা ছিল ক্রান্তিকালীন অর্থনীতি। তা ছাড়া, দুটি দেশ দীর্ঘ সময় ধরে লালিত হয়েছিল দুটি ভিন্ন ধ্যানধারণায়। আঞ্চলিক পার্থক্য তো ছিলই। তাই ঐক্যবদ্ধ জার্মানিতে পূর্ব অংশের জনগণের মধ্যে অধিক গণতন্ত্র, ব্যক্তি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দ্রুত চলে এলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ব্যাপারে তারা কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। এসব কারণে পূর্বের জনগণের মধ্যে সামাজিক স্বীকৃতি না পাওয়ার বঞ্চনা ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছিল।

তবে সেই পুরোনো হতাশাবোধকে পুঁজি করে ধর্ম-বর্ণ, শরণার্থী ও অভিবাসীবিরোধী কট্টরবাদী রাজনীতিকে সমর্থন জোগানো কখনোই গণতান্ত্রিক রাজনীতির সহায়ক হতে পারে না। তা ছাড়া, এই রাজনীতি ঐক্যবদ্ধ জার্মানির চেতনার পরিপন্থী।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর জার্মান সরকারের পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি রাজ্য বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক সচিব ক্রিশ্চিয়ান হির্টে জানিয়েছেন, জার্মানির পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতি ক্রমেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। পশ্চিমের তুলনায় পূর্বের কাঠামোগত দুর্বল অবস্থা থাকলেও ঐক্যভুক্ত জার্মানির শুরুর দিকের তুলনায় এখন পূর্বের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি মজুরি, বেতনকাঠামো, অবসর ভাতা, পারিবারিক আয় বেড়েছে। কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে। ১৯৯০ সালের পর পূর্বাঞ্চলে জরাজীর্ণ অর্থনীতির কারণে তরুণ-তরুণীদের পশ্চিমে চলে যাওয়ার যে ঝোঁক ছিল, তা ক্রমেই কমে আসছে।

জার্মানির স্পিগেল পত্রিকা সম্প্রতি হামবুর্গের কর্বার ফাউন্ডেশনের একটি জরিপ প্রকাশ করেছে। নতুন এই জরিপে দেখা যাচ্ছে, সাবেক পূর্ব জার্মানির পাঁচটি রাজ্যের ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করছে, ঐক্যবদ্ধ জার্মানি তাদের জন্য সুফল বয়ে এনেছে। অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলে তা মনে করে ৫৩ শতাংশ মানুষ।

এই বছর ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে জার্মানির অর্থনীতিবিষয়ক প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে ইউরোপের নানা দেশে অর্থনৈতিক মন্দা থাকলেও জার্মানির কেন্দ্রীয় সরকার রেকর্ড পরিমাণ আয় করছে। জার্মানির কেন্দ্রীয় সরকার, ১৬টি রাজ্য ও পৌরসভাগুলোতে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় মিটিয়ে ৫৮ বিলিয়ন ইউরো উদ্বৃত্ত রয়ে যায়। এই বছরের মে মাসে প্রকাশিত অন্য একটি খবরে বলা হয়েছে, এই বছর প্রথম চার মাসে আগের তুলনায় জিডিপির হার বেড়েছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ।

জার্মানির ২৯ বছরের ইতিহাসে পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, কিছু বৈষম্য, কিছু অসন্তোষ, কট্টরবাদীদের আস্ফালন থাকলেও জার্মানি এগোচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মান জাতি বিভক্ত হয়ে পড়লেও সেই বিভক্তিকে পেছনে ফেলে ঐক্যবদ্ধভাবে জার্মানি এগিয়ে যাচ্ছে। ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আঙ্গেলা ম্যার্কেল আর তাঁর সহযোগী রাজনীতিকেরা জাতীয়, আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে ক্রমেই জার্মানিকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলছেন।

সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
[email protected]