পাকিস্তান শুধু ভারতের জন্য হুমকি নয়

ইমরান খান। ছবি: রয়টার্স
ইমরান খান। ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানের ডিপ স্টেট বা রাষ্ট্র পরিচালনার পেছনের শক্তি শান্তির পদক্ষেপে কখনো সাড়া দেয়নি। ১৯৯৯ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি যখন বন্ধুত্বের বাস লাহোরে নিয়ে যান, তখন তার বিনিময়ে তিনি পেলেন কারগিল যুদ্ধ, আইসি-৮১৪ বিমান ছিনতাই এবং ভারতের পার্লামেন্টে প্রতিশোধমূলক হামলা। 

বাজপেয়ির উত্তরসূরি মনমোহন সিং পারভেজ মোশাররফের সঙ্গে টেকসই শান্তি চেয়েছিলেন, ধরে নিয়েছিলেন যে এতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সম্মতি থাকবে। তবে তিনি যা পেয়েছিলেন, তা হলো পাকিস্তানের তৈরি ইন্ডিয়ান মুজাহিদীন (আইএম) এবং ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলা।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও ব্যতিক্রম কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে কাবুল থেকে ফেরার পথে লাহোরে গিয়ে তিনি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে অবাক করে দিয়েছিলেন। তখন সেখানে নওয়াজ শরিফের মেয়ের বিয়ে হচ্ছিল। মোদি নওয়াজকন্যাকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলেন। এর এক সপ্তাহ পর পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মোহম্মদ ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের পাঠানকোটে হামলা চালায়। তবে সৌভাগ্যক্রমে ভারতীয় বাহিনী এই হামলা প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। জইশ-ই-মোহম্মদ ভারতীয় বিমানবাহিনীর যোদ্ধাদের এবং তাদের স্থাপনা একেবারে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। জম্মু ও কাশ্মীরে নয়াদিল্লির সাম্প্রতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইসলামাবাদের ব্যাপক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তারা এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সামান্যই সমর্থন পেয়েছে।

তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি নিয়ে আলোচনা, যেখানে পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল, আপাতত একটি ধাক্কা খেয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আলোচনা বাতিল করে দিয়ে এ বিষয়ে এক অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে চলতি মাসের শেষের দিকে প্যারিসে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) বৈঠকে পাকিস্তানের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে। ব্যাপক হারে অর্থ তছরুপ এবং সেই সঙ্গে জঙ্গিদের অর্থ সাহায্য করা—এই দুই অভিযোগে এক বছর আগেই পাকিস্তানকে ধূসর তালিকাভুক্ত করেছিল এফএটিএফ। এবার সংস্থাটি পাকিস্তানকে সরাসরি কালো তালিকাভুক্ত করতে পারে বলে পাকিস্তানের অনেকের আশঙ্কা। 

পাকিস্তান খুব চাইছে কাশ্মীরের ওপর সারা বিশ্বের নজর পড়ুক। তবে জেনেভা ও নিউইয়র্ক উভয় স্থানেই পাকিস্তান জাতিসংঘের সামান্য সমর্থন পেয়েছে। এ কারণেই পাকিস্তানের রাষ্ট্র পরিচালনাকারী শাসকদের দর্শনীয় কিছু করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে তাতে ভারতের কিছু এসে যাবে না, কারণ পাকিস্তানের রাষ্ট্র পরিচালনাকারী শক্তিগুলো অতীতের শান্তি উদ্যোগগুলোয় ঠিক এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। তবে পাকিস্তানের অস্থিতিশীল ভবিষ্যৎ অনিবার্যভাবেই ভারতের ওপর প্রভাব ফেলবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান স্পষ্টভাবেই পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন। তিনি সদ্য অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বলেছেন, যদি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো যুদ্ধ হয়, তাহলে ছোট দেশে হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার ছাড়া পাকিস্তানের কোনো বিকল্প থাকবে না।

অবশ্য পাকিস্তানের পক্ষে এ ধরনের হুমকি দেওয়াই স্বাভাবিক। যে দেশ সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোকে আশ্রয় দেয় ও পৃষ্ঠপোষকতা করে, তারা কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে না। দুই মাস ধরে দেশটির কার্যক্রমে বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। পাকিস্তান সম্পর্কে এগুলো কোনো অজানা তথ্য নয়। তবু যতবারই ইসলামাবাদ গুরুতর চাপের মুখে পড়েছে, ততবারই এটি তার ভূরাজনৈতিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৭০-৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র এমনটা দেখেছে। ১৯৯০-এর দশক থেকেই এটি চীন দেখছে। এই উভয় শক্তিই বিভিন্ন সময় পাকিস্তানের কৌশলগত উপযোগিতা দেখেছিল যে তারা দিনের পর দিন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর উত্থানকে অন্যভাবে দেখতে প্রভাবিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি চলতি মাসেই মামাল্লাপুরমে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে স্বাগত জানাবেন। তখন পাকিস্তানের বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনায় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে বিশ্বের দুই জনবহুল দেশ অন্তত সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে একমত। 

ভারত এখন কেবল অর্থনৈতিকভাবেই শক্তিশালী নয়, এটি রাজনৈতিকভাবেও আরও স্থিতিশীল। জম্মু ও কাশ্মীরের ব্যাপারে অভ্যন্তরীণভাবে কিছু সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের পরে নয়াদিল্লিকে পাকিস্তানের প্রতি দৃঢ়ভাবে নজর দিতে হবে। কিছু অনিবার্য কারণে ভারত সব সময়ই কাশ্মীর সম্পর্কে পাকিস্তানের কাছে ব্যাখ্যা করতে বাধ্য হয়েছে, যদিও কাশ্মীর পরিস্থিতির সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো যোগসূত্র নেই বা এ ব্যাপারে তাদের করারও কিছু নেই। সত্যটি হলো ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে কাশ্মীর সম্পর্কে যেকোনো ঘরোয়া কথোপকথন, তা পাকিস্তানের পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসবাদের কারণে দুর্বল হয়েছে। এখন পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী অবকাঠামো কেবল ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই নয়; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তার মিত্রদেশগুলো এবং সম্ভবত ভবিষ্যতে এমনকি চীনও হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। পাকিস্তান স্বল্প সময়ে এই দেশগুলোকে যে কৌশলগত সেবা সরবরাহ করতে পারে, এই বাস্তবতা তার চেয়ে অনেক বড় বিপদের।

দ্য ইকোনমিক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
প্রণব ঢাল সামন্ত দ্য ইকোনমিক টাইমস পত্রিকার উপনির্বাহী সম্পাদক