যশোরের ভৈরব নদ

আমরা সাধারণত অবৈধ নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে নদীর ওপরে নানা ধরনের অবৈধ অবকাঠামো তৈরির বিষয়ে উষ্মা প্রকাশে অভ্যস্ত। কারণ, সারা দেশের সিংহভাগ নদীখেকো হলো প্রভাবশালীরা। তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় টিকে আছে। কিন্তু ভৈরব নদের টুঁটি চেপে ধরার পেছনে রয়েছে খোদ সরকারি কর্তৃপক্ষ। তারা মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের নামে কোনো বাছবিচার ছাড়াই গত দুই দশকের বিভিন্ন সময় সেতু ও কালভার্ট তৈরি করেছে। তারা কখনো ভাবেনি যে ভৈরব ও তার সন্নিহিত অঞ্চলের জনগণের লাইফ লাইন যে নদ, তার ওপরে এসব ‘বৈধ’ অবকাঠামো নির্মাণের প্রভাব কী হতে পারে। ১৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ভৈরবের ইতিমধ্যে ৯৩ কিলোমিটারের জলধারা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। একসময় খুলনা থেকে পানিপথে যশোরে সরাসরি পণ্য পরিবহন হতো। কিন্তু ভৈরব শীর্ণকায় হওয়ার পরে তা আজ শুধুই স্মৃতি।

তবে অনেক বিলম্বে হলেও নদটি পুনঃখননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই এলাকায় সফরে গিয়ে নদটি পুনঃখননে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রায় ২৭৩ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ এই খননকার্য এগিয়ে চললেও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে এই বিনিয়োগ পানিতে ফেলে দেওয়া হবে কি না। কারণ, একদিকে পুনঃখননের কাজ চলছে, অন্যদিকে নদ হত্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া বৈধ কাঠামোগুলো অপসারণে কোনো পরিকল্পনার কথা জানা যাচ্ছে না।

 ভৈরবের নাব্যতা ফিরিয়ে আনার বিষয়টি এই অবৈধ কাঠামো অপসারণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে বহুলাংশে জড়িত। ৫১টি কাঠামোর মধ্যে শুধু এলজিইডি ২৪টি সেতু করেছে। অথচ প্রচলিত আইন হলো, যেসব স্থায়ী কাঠামোর সঙ্গে নদী বা জলাধারের সম্পর্ক থাকবে, সেখানে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র লাগবে। আলোচ্য স্থায়ী কাঠামোগুলো কীভাবে তৈরি হয়েছে এবং নির্মিত হওয়ার পরেও পরিবেশ অধিদপ্তর এসব ভুল শোধরাতে কী ভূমিকা রেখেছে, তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। কারণ, একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে দেশের অন্যত্র না ঘটে, তার নিশ্চয়তা দরকার।

 ৫১টি সেতু ও কালভার্ট ছাড়া অন্য আরও কিছু বিষয় থাকতে পারে, যা নদটিকে একটি মজা খালে পরিণত করতে ভূমিকা রেখেছে। সেগুলোও চিহ্নিত করা জরুরি। সব থেকে উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, অধিকাংশ সেতুর দৈর্ঘ্য নদের তুলনায় অপ্রশস্ত। এটা পরিহাসের বিষয় যে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) খোঁজ নিয়ে জানতেই পারেনি ৫১টি সেতু–কালভার্টের মধ্যে ১০টি কারা করেছে।

বর্তমান পুনঃখনন প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ২০২১ সালের জুনে। বর্তমানে নদের উজান ও ভাটিতে ৭৭ কিলোমিটারের খনন চলমান রয়েছে। এই মুহূর্তে খননে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত সেতু-কালভার্ট। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে এই অচলায়তন ভাঙতে হবে।