অসাম্প্রদায়িকতার বাণীবাহী দুর্গেশনন্দিনী

পুরান ঢাকার নারিন্দার গৌর মন্দিরে পূজারিদের অঞ্জলি দেওয়ার আগে।  ছবি: জয়দেব সরকার
পুরান ঢাকার নারিন্দার গৌর মন্দিরে পূজারিদের অঞ্জলি দেওয়ার আগে। ছবি: জয়দেব সরকার

বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। ষড়্ঋতুর এই দেশে প্রতিটি ঋতু আমাদের দেহ ও মনকে স্পর্শ করে যায়। যদিও পরিবেশ ও আবহাওয়া বিপর্যয়ের কারণে প্রতিটি ঋতুর স্বভাব আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু ৩০ থেকে ৪০ বছর আগেও আমরা দেহমনে ঋতু ও ঋতুর পরিবর্তন অনুভব করতাম।

প্রবল গ্রীষ্মের পরে শীতের আগমনের মাঝে আসে শরৎকাল। বর্ষার পরেই শরতের আগমন আমাদের মনে এক রোমাঞ্চকর ভাব নিয়ে আসে। আমরা ঢাকের বাদ্য শুনতে পাই। ঢাক, কাঁসর যতই উচ্চকিত হতে থাকে, ততই ঘনিয়ে আসে দুর্গেশনন্দিনী মা দুর্গার আগমনকাল। গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহ, নানা ধরনের ব্যাধি—সবকিছুকে নিরাময় করে দুর্গার আগমন ঘটে। গ্রামবাংলা মুখরিত হয় নানা ধরনের আনুষ্ঠানিকতায়। পূজামণ্ডপ একেবারেই নতুন সাজে সজ্জিত হয়, সন্ধ্যায় আরতিতে এক বর্ণাঢ্য আয়োজনে আবালবৃদ্ধবনিতা যুক্ত হয়ে যায়। শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নয়, এই আয়োজনে সমগ্র বাঙালি জাতি অংশগ্রহণ করে থাকে।

পূজার আনন্দ ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে তুঙ্গে উঠে যায়। দশমীতে বিসর্জনের বিষাদ নেমে আসে। বিসর্জন শেষে মা দুর্গার বিদায়ের পরে জনজীবনে এক নতুন প্রেরণা নিয়ে দিন শুরু হয়। দুর্গাপূজায় যেহেতু সব ধর্মের মানুষের পরোক্ষ অংশগ্রহণ থাকে, তাই এটি পরিচিত হয় শারদীয় উৎসব হিসেবে। যেসব বাঙালির উৎসবে অসাম্প্রদায়িকতা খুঁজে পাওয়া যায়, তার মধ্যে দুর্গাপূজা অন্যতম। ভারতে বড় বড় প্রতিমা নির্মাণের কাজও করে থাকেন মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা। বাংলাদেশেও কোথাও কোথাও মুসলমান সম্প্রদায়ের শিল্পীরা এই কাজ করে থাকেন।

পূজার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে প্রতিমা। এই প্রতিমা যখন মুসলমান শিল্পীরা করেন, তখন ধর্মের বাছবিচারটা অবলুপ্ত হয়ে যায়। প্রতিদিনই মণ্ডপে অন্য ধর্মাবলম্বীরা আসেন এবং সেখানে দেবতার ভোগ থেকে শুরু করে যেসব খাদ্য তৈরি হয়, সেগুলোর স্বাদও গ্রহণ করেন। দলমত-নির্বিশেষে এই যে নিমন্ত্রণের রীতি, তা বহুকাল থেকে চলে আসছে।

বাঙালি সমাজে সেই প্রাচীনকাল থেকেই দুর্গাপূজাকে সর্বজনীন করার প্রচেষ্টা ছিল। যে কারণে বারবার একটি শব্দ উচ্চারিত হয়, তা হলো সর্বজনীন। সর্বজনীন বলতে শুধু যে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বোঝায় না, তা আয়োজনের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়।

সনাতন ধর্মের বর্ণপ্রথা অত্যন্ত কঠোরভাবে শ্রেণিবদ্ধ। আর্যদের সৃষ্ট ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং একেবারেই ম্লেচ্ছ বলে শ্রেণিবদ্ধ বিষয়টি মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে বিভক্ত করেছে। এই বিভক্তি শাসক ও শোষিতরা শতাব্দীর পর শতাব্দী মেনেও নিয়েছে। জন্মগতভাবে প্রাপ্য এই শ্রেণিবিভক্তিতে মানুষের কোনো হাত নেই। এ যেন নিয়তিনির্ধারিত এক অমোঘ রীতি। ব্রাহ্মণ শাসন করবে, ক্ষত্রিয় যুদ্ধবিগ্রহে রত থাকবে, বৈশ্য ব্যবসা-বাণিজ্য করবে এবং শূদ্র ও ম্লেচ্ছরাও হীন কাজে লিপ্ত হবে। এই অবস্থা থেকে অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও হয়তো একটা সমন্বয় সাধনের চেষ্টা হয়েছিল উৎসবের মাধ্যমে। মা দুর্গার এই মাতৃরূপের যে প্রতিচ্ছবি নির্মাণ করা হয়, তাতেই বোঝা যায় শত্রু সংহার করে এক উদ্ধারকর্মে বিপুল শক্তি নিয়ে তিনি আসেন। তিনি আসেন এবং তাঁর দায়িত্ব পালন করে আবার বিদায়ও নেন। সনাতন ধর্মের দেবদেবীরা মানুষের কাছাকাছি বলেই তাঁরা নিরাকার নন এবং আকারগুলো খুবই প্রতীকী।

১৯৭১ সালে ভারতে দুর্গার চেহারাটা ছিল অনেকটা ইন্দিরা গান্ধীর মতো এবং দুর্গাকে সুন্দরী করার প্রবল প্রচেষ্টা থাকে শিল্পীদের মধ্যে। বিদ্যাদেবী সরস্বতী অপূর্ব সুন্দরী। বিদ্যা যেহেতু সৌন্দর্যের তত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত, তাই তাঁকে সুন্দরী হতেই হয়। আরেক সুন্দর প্রাণী হংসের ওপর তাঁর অধিষ্ঠান। সব মিলিয়ে সরস্বতীর রূপ বাল্যকাল থেকেই মানুষের মনে গেঁথে যায়। লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচা। প্যাঁচা রাতজাগা প্রাণী। দিনের বেলায় তাকে দেখা যায় না। বোঝা যায় ব্যবসা-বাণিজ্য অত্যন্ত চালাক-চতুরের কাজ। তাই লক্ষ্মীপ্যাঁচার ওপরে অধিষ্ঠান হয়ে যাতায়াত করেন লক্ষ্মী। অন্যতম জনপ্রিয় পূজা হচ্ছে গণেশের। গণেশ বেশ বড় একটা উদর নিয়ে থাকা সুখী দেবতা। নাকটা হাতির। গণেশের সঙ্গে ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসের একটা বিষয় আছে। গণেশের অন্য নাম গণপতি। আদিম সাম্যবাদী কৌমসমাজে গণপতিরা ছিলেন নেতা। তাঁরা সুষম বণ্টন করতেন, সমাজকে নেতৃত্ব দিতেন। ভারতে যখন বৃহৎ সামন্তবাদের উত্থান হয়, তখন গণপতিরা হাতির পিঠে করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সেই যুদ্ধে গণপতি পরাজিত হন, যে কারণে ওই হাতির একটি দাঁত ভেঙে যায়। গণেশ অনার্য দেবতা এবং মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয়ের সমাধান করে থাকেন। তাই ভারতবর্ষের মানুষ গণেশকে প্রত্যহ পূজা করে। মহাভারতের রচয়িতা যেহেতু মানুষ, তাই প্রতিটি দেবদেবীর আচার-আচরণের সঙ্গে মানুষের প্রাত্যহিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত আছে। কৃষ্ণ একাধারে প্রেম এবং কূটনীতির দেবতা। তিনিও প্রাত্যহিক পূজার বিষয়। নারীকুল কৃষ্ণের আকাঙ্ক্ষা করেন, আবার সমাজপতিরা কৃষ্ণের কূটনীতিকে গ্রহণ করেন।

মানুষ প্রতিনিয়তই নানা ধরনের প্রতিকূলতার মধ্য থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় লিপ্ত থাকে। একধরনের আধ্যাত্মিকতা বস্তুবাদী জীবনে তার প্রয়োজন হয়। তাই তার মনোজগতে আবির্ভাব ঘটে দুর্গেশনন্দিনী দুর্গার। অনিষ্ট বিনাশিনী দুর্গেশনন্দিনী দুর্গা। সেই দুর্গা এসেছেন এখন বাংলার ঘরে ঘরে। দুর্গা যেন অসাম্প্রদায়িকতার বাংলার নবতম প্রেরণা হয়ে ওঠেন।

মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।