দুর্ঘটনা কমাতে সাহায্য করতে চাই

হার্টউইগ শেফার ও জঁ টড
হার্টউইগ শেফার ও জঁ টড
>

সম্প্রতি ঢাকা সফর করে গেছেন জাতিসংঘ মহাসচিবের সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক বিশেষ দূত জঁ টড ও বিশ্বব্যাংক দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্টউইগ শেফার। প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তাঁরা কথা বলেছেন বাংলাদেশের সড়ক নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক নিয়ে। বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে তৈরি আছে জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহীদ এজাজ ও জাহাঙ্গীর শাহ

প্রথম আলো: বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সড়ক ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা—কোন বিষয়টিকে সামনে রাখবেন?

হার্টউইগ শেফার: প্রতিবছর অন্তত ১৩ লাখ লোক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। সারা বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই উন্নয়নশীল দেশের। আর এর বড় অংশটা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৪ জনের ১ জন হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার। এসব দুর্ঘটনায় শিশু, চালকসহ যাঁরাই প্রাণ দিচ্ছেন, তা কিন্তু প্রতিরোধ করা যায়। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধের বিষয়টিতে আমরা জোর দিচ্ছি।

জঁ টড: এইডসের মতো প্রাণঘাতী রোগের কোনো প্রেসক্রিপশন হয় না। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা যায়। স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি আর অঙ্ক শেখার পাশাপাশি সড়কে কীভাবে চলতে হবে, সেটাও জানতে পারে। তাই আমার কাছে সড়ক দুর্ঘটনা রোধই প্রথম অগ্রাধিকার। মনে রাখতে হবে, দুর্ঘটনা শুধু মৃত্যুই ডেকে আনে না। বেঁচে যাওয়া লোকজন পঙ্গু হয়ে পড়ে। বিকলাঙ্গ হয়ে পড়া মানুষ শুধু পরিবার নয়, বোঝা হয়ে ওঠে সমাজ আর রাষ্ট্রের জন্য। তাই সড়কের ব্যবস্থাপনা ঠিক করা জরুরি মনে করি। এরপর আসবে আইন প্রয়োগের বিষয়টি। সড়ক অবকাঠামোর মান এ অঞ্চলে বেশ খারাপ, দ্রুত তাদের হাসপাতালে পৌঁছানোর বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাত্রাতিরিক্ত ট্যাক্সির উপস্থিতিতে লোকজনের চাহিদা অনুযায়ী গণপরিবহনের অবাধে সড়কে চলাচল দুরূহ হয়ে পড়ে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে গড়ে দুর্ঘটনার ১০ মিনিটের মধ্যে আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। আর বাংলাদেশের মতো দেশে আহত লোকজনকে হাসপাতালে নিতে গড়ে সময় লাগে কয়েক ঘণ্টা। ফলে এত দেরিতে তাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়, যখন আর কিছুই করার থাকে না।

প্রথম আলো: ভারতে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্ব গণপরিবহন চালুর মধ্য দিয়ে সুশাসন নিশ্চিত হয়েছে। পাশাপাশি যৌথ এ উদ্যোগ সড়ক ব্যবস্থাপনার উন্নতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের জন্য এই অভিজ্ঞতা কতটা কাজে লাগতে পারে?

হার্টউইগ শেফার: এই মডেল এখানেও বেশ নির্ভরযোগ্য ও ভালো সেবা নিশ্চিত করতে পারে। বিভিন্ন দেশে র‍্যাপিড বাস সিস্টেম ও গণপরিবহন বেসরকারি খাতের সহযোগিতায় চলে। লোকজন নির্ভরযোগ্যতা ও নিরাপত্তার পাশাপাশি কম খরচে গণপরিবহনের সেবা পেতে চান। ঢাকার মতো রাস্তায় গাড়ি, বাস, রিকশাসহ নানা ধরনের যান যখন একসঙ্গেই চলে, সে ক্ষেত্রে সমাধানের অন্যতম বিকল্প হতে পারে কম খরচে গণপরিবহনের সেবা নিশ্চিত। এ ধরনের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি–বেসরকারি একটি সমাধান হতে পারে। সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য আরেকটি উপায় হচ্ছে গণপরিবহনের জন্য নির্দিষ্ট লেনে চলাচল ঠিক করে দেওয়া। তখন লোকজনও জানতে পারে কোন সময়ে ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়ালে সে গণপরিবহনে চড়তে পারবে। কাজেই জনগণকে নিরাপদে নির্দিষ্ট স্থান থেকে ওঠা-নামার ব্যবস্থাও সড়কে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার অন্যতম উপায়।

প্রথম আলো: রেল ও নৌপথে লোকজন কম খরচে চলাফেরা করতে পারে। অথচ যোগাযোগ অবকাঠামোর মূল নজর সড়কে। সাহায্য সংস্থাগুলোও বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে সড়কে। যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নে সড়ক থেকে অন্য খাতগুলোতে নজর বাড়ানোর কি সময় আসেনি?

হার্টউইগ শেফার: দুই মাস আগে আমি (সদরঘাটে গিয়েছিলাম যেখান দিয়ে) জেনেছি, প্রতিবছর অন্তত চার কোটি মানুষ নৌপথে যাতায়াত করে। বাংলাদেশের মতো দেশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নৌপথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রাম থেকে জেলা হয়ে ঢাকায় লোকজনের পৌঁছানোর পাশাপাশি পণ্য পরিবহনে নৌপথ গুরুত্বপূর্ণ। তাই বাংলাদেশের নৌপথ সারা বছরই চলাচলের উপযোগী রাখতে সহায়তা করছে বিশ্বব্যাংক। আমরা তো দেখছি গ্রামের সঙ্গে শহরের সংযোগে নৌপথে যোগাযোগ অনেক বেশি কার্যকর। তাই বাংলাদেশের মতো দেশে আমাদের নৌপথের ওপর বেশি জোর দেওয়া উচিত। এ জন্য বিশ্বব্যাংক কাজ করছে।

প্রথম আলো: ঢাকা ও চট্টগ্রামে নগর গণপরিবহনব্যবস্থায় একধরনের নৈরাজ্য চলছে। সড়কের তুলনায় যানবাহন বেশি, আবার জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে তুলনামূলক যানবাহন কম। এমন প্রেক্ষাপটে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত করা হবে?

জঁ টড: সমস্যাটা বেশ জটিল। তাই আপনাকে পরিস্থিতির পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। ঢাকার মতো বিপুল জনগোষ্ঠীর শহরে কার্যকর গণপরিবহন নেই। একই সড়কে যখন দ্রুতগতির যানের পাশাপাশি রিকশার মতো শ্লথগতির বাহন চলে, তখন তা নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করে। তাই যানবাহনসেবার উন্নতি ঘটাতে হবে। এখনো ঢাকার রাস্তায় অনেক পুরোনো বাস চলতে দেখেছি। এই যানগুলো মোটেই নিরাপদ নয়। অনেক লোক গাদাগাদি করে বাসগুলোতে চড়ছে। বাসের ভেতরকার পরিবেশও অস্বাস্থ্যকর। আমাদের গণপরিবহনের মানের উন্নতি ঘটাতে হবে। সড়কের অবকাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে। সড়কে ট্রাফিক লাইট নেই বললেই চলে। ঢাকার অনেক জায়গায় বৃত্তাকার সড়ক মোড় নেই। উপরন্তু শহরজুড়ে সংস্কারকাজ চলছে। এটাও সড়কে যানবাহনের গতি কমিয়ে দিচ্ছে। কাজেই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, যানজট, দূষণ আর নিরাপত্তার বিষয়টির সঙ্গে জনগণ জড়িত। কারণ, তারা যেখান–সেখান দিয়ে চলাচল করছে। ফলে তারা যখন-তখন যেখান–সেখান দিয়ে চলাফেরা করতে গিয়ে একধরনের অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। সবকিছু মিলিয়ে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, যেটা নিয়ে কারও কোনো ধারণা নেই।

প্রথম আলো: সড়ক নির্মাণে ঠিকাদারদের নিম্নমানের কাজের কারণে মহাসড়কে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে, প্রাণহানি হয়। দুর্ঘটনা এড়াতে কীভাবে সড়কের মান নিশ্চিত করা যায়?

হার্টউইগ শেফার: সড়কের কাজের মানের বিষয়টিকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। কয়েক বছর আগে সড়কের কাজের মানের ক্ষেত্রে পরিবেশের পাশাপাশি সামাজিক মানদণ্ডের বিষয়টি আমরা হালনাগাদ করেছি। অর্থাৎ আমাদের অর্থায়নে নির্মিত সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে নিরাপত্তার ন্যূনতম শর্ত পূরণ করতে হবে। এই নিরাপত্তা শুধু নির্মাণকর্মীদের নয়, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাও বটে। যেমন হাইওয়েতে এক্সিট র‍্যাম্প, বিটুমিনের দিকে লক্ষ করলে দেখতে পাবেন, এগুলো সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রকল্পের আশপাশের লোকজনের জন্য দীর্ঘদিনের চলাচলও নিশ্চিত করছে। এই শর্তগুলো পূরণের স্বার্থে সড়ক নিরাপত্তার ব্যাপারে আপনি অডিটও চালাতে পারেন। আমরা যে প্রকল্পগুলো করছি, সেগুলো নিরাপত্তার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করছে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে যানবাহনের চালকদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন একটা নেই। ট্রাফিক সংকেত ও আইন সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা নেই। এটিও দুর্ঘটনার বড় কারণ। বাংলাদেশের কী করা উচিত?

জঁ টড: ভালো কোনো প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে চটজলদি লাইসেন্স না পেলেই একজনের পক্ষে ভালো চালক হয়ে ওঠা সম্ভব। লাইসেন্সটা আপনাকে পয়েন্টের ভিত্তিতে পেতে হবে। নিয়ম লঙ্ঘন করলেই আপনার পয়েন্ট কমে যাবে। আপনি সবগুলো পয়েন্ট হারালে আপনার লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। তাই লাইসেন্স ফিরে পেতে হলে আপনাকে বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। শুধু চালক নয়, পথচারী হিসেবেও আপনাকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। পথচারী সতর্ক না থাকলে তা গাড়ি কিংবা মোটরসাইকেল যেকোনো যানের জন্যই ঝুঁকি তৈরি করবে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের আইনে চালকদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় তাঁরা বেপরোয়া হয়ে থাকেন। সড়ক দুর্ঘটনায় আইনের পরিবর্তন কতটা জরুরি?

হার্টউইগ শেফার: আইন কাগজে থাকা আর কার্যকরভাবে আইন প্রয়োগের মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান রয়েছে। সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উন্নতির মাধ্যমে যেসব দেশ হতাহতের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পেরেছে, সে দেশগুলোতে আইন ও আইনের প্রয়োগ সফলভাবে করছে। এ জন্য সড়ক দুর্ঘটনা রোধে অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে আচরণের পরিবর্তন ঘটানো জরুরি।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যাংক কীভাবে সহায়তা করতে পারে?

হার্টউইগ শেফার: অর্থমন্ত্রী এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে জেনেছি, বাংলাদেশ সরকার সড়ক নিরাপত্তার গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং এ ব্যাপারে আইন আছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক একসঙ্গে মিলে বাংলাদেশ সরকারকে আইনের প্রয়োগে সহায়তা করতে পারে। আমরা একটি কৌশল ঠিক করার কাজে যুক্ত হতে পারি, যেখানে পাঠ্যক্রমের বিষয়টিও থাকবে। এমনভাবে কাজটি করা হবে, যাতে সংশ্লিষ্ট সবগুলো সংস্থা যুক্ত থাকতে পারে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক মহল থেকে এ ব্যাপারে অঙ্গীকার রয়েছে।

প্রথম আলো: আপনাদের ধন্যবাদ।

হার্টউইগ শেফার: ধন্যবাদ।

জঁ টড: ধন্যবাদ।