জীবনের ডাক দিয়ে যায়

তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। ফাইল ছবি
তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। ফাইল ছবি

সময় ধুলো উড়িয়ে চলে। মাথা ও বুকের ভেতর থরে থরে জমে থাকা কথার পরতে পরতে জমে ওঠে ধুলোর আস্তরণ। জীবনের যে কথা স্পর্ধিত, গৌরবের, পাখা ছড়িয়ে ওড়া প্রজাপতির মতো উচ্ছ্বসিত অথবা শায়কবিদ্ধ পাখির ঝাপটানো ডানায় ছড়িয়ে দেওয়া দুঃখের, বেদনার—সব ঢাকা পড়ে যায়। তবু মাঝেমধ্যে অথবা কোনো কোনো দিন ধুলো ঠেলে বেরিয়ে আসে বাক্সবন্দী সে আনন্দ অথবা দুঃখের হিরণ্ময় চকচকে স্মৃতির পাথর। ৫ অক্টোবর তেমনই একটি দিন। ত্বকীর জন্মদিন।একসময় যে দিনটি ছিল আমাদের কাছে লাল-নীল ঘুড়ির মতো আকাশে ওড়া বর্ণিল এক অনাবিল উৎসব, সুবাস ছড়িয়ে দেওয়া ফুলের সমারোহ, এখন তা বিবর্ণ ধূসর, কেবলই হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়ে তোলার অনুভব। কষ্টটা আরও বাড়িয়ে তুলেছে এ নৃশংসতার বিচারহীনতা।

ত্বকীর বেড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জ শহরে। এ শহরে ঐতিহ্য প্রাণপ্রাচুর্যের কমতি ছিল না। শহরের পথ, ফুটপাত, অলিগলি, বৃক্ষ, বন্দর, নদী—সব চেনা। সবকিছুর সঙ্গেই রয়েছে এক নিবিড় পরিচয়। কিন্তু নিষ্ঠুরতা আর নৃশংসতা যখন রাজনীতির অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে; সেখানে ঐতিহ্য, প্রাচুর্য, অহংকার মুখ থুবড়ে পড়ে, মানুষ বিপন্ন হয়ে পড়ে, সব হারিয়ে কেবলই নিঃসহায় হতে থাকে।

ত্বকী রবীন্দ্রনাথের গান গাইত, আবৃত্তি করত, বাংলা ও ইংরেজিতে কবিতা ও ছোট ছোট নিবন্ধ লিখত। লালনের গান ওর প্রিয় ছিল। টলস্টয়, আইনস্টাইনের প্রতি যেমন আকর্ষণ ছিল, আবার প্রাচ্যের দর্শন ও সুফিবাদের প্রতিও আকর্ষণ ছিল। শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান—সবকিছুর প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। নিখোঁজ হওয়ার পরদিন ওর ‘এ’ লেভেল প্রথম পর্ব পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানে বিশ্বে ও রসায়নে দেশের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে ত্বকীর ঠিকানা নিশ্চিত হয়েছে শীতলক্ষ্যা নদীতে।

ত্বকীকে যে টর্চার সেলে নিয়ে বন্দী করা হয়েছিল, তা শহরের পরিচিত এক আতঙ্কঘর। প্রশাসনের সবই জানা। তারপরও টর্চার সেলটি ছিল, বীরদর্পেই মাথা উঁচিয়ে ছিল। ঘাতকেরা হয়তো জানত, তাদের বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কখনোই কারও হবে না। তদন্ত সংস্থা র‍্যাবের তথ্য অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জের চিহ্নিত একটি পরিবারের ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে। প্রথমে তারা গজারির লাঠি দিয়ে পিটিয়ে নিস্তেজ করে মাথায় আঘাতের পর আঘাত করতে থাকলে ত্বকী জ্ঞান হারিয়ে যখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, তখন ঘাতকেরা তার বুকের ওপর উঠে গলা চেপে শ্বাস রোধ করে ১৭ বছরের অপাপবিদ্ধ কিশোরের মৃত্যু নিশ্চিত করে। ঘাতকেরা তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ থেঁতলে দেয়, একটি চোখ উপড়ে আনে। সমস্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পরেও ঘাতকদের বিচারে আওতায় আনা হয়নি। এখন সাত বছর হতে চলেছে। অথচ ঘটনার এক বছরের মাথায় তদন্ত সংস্থা তদন্ত শেষ হওয়ার ঘোষণা দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল, কখন, কোথায়, কীভাবে, কেন এবং কারা কারা মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে। তখন যে অভিযোগপত্র তারা সংবাদকর্মীদের সরবরাহ করেছিল, তা আজও আদালতে পেশ করা হয়নি। আমাদের দেশে বিচার বন্ধ রাখার নজিরের অভাব নেই। কিন্তু সমস্ত তথ্যপ্রমাণ প্রকাশের পরে অপরাধীদের দলীয় আনুগত্যের কারণে তা বন্ধ করে দেওয়ার নজির হয়তো খুব বেশি পাওয়া যাবে না।

ত্বকীর নদী ও সমুদ্রের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা। বহু নদীতে ওকে নিয়ে বেড়িয়েছি। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ নিখোঁজ হলে আমরা এখানে-সেখানে কত-না জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেছি। কিন্তু দুদিন পর শীতলক্ষ্যাই হয়ে উঠল তার সলিলসমাধির জায়গা। বহুবার এ শীতলক্ষ্যা আমরা একসঙ্গে পাড়ি দিয়েছি। এ আমাদের সাত পুরুষের ঠিকানা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সাক্ষী। এখানেই জেনেছি নিজেকে; দুঃখের মুখোমুখি হয়েছি এখানেই। এ নদীই হয়ে রইল ত্বকীর নিষ্ঠুর পরিসমাপ্তির জ্বলন্ত সাক্ষী।

গতকাল ছিল তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর জন্মদিন। ২৪ বছর পূর্ণ হলো। তবে ত্বকীর বয়স আর বাড়ছে না। ১৭ বছর ৫ মাসে আটকে গেল একটি জীবনচক্র। কিন্তু তা না বাড়লেও প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে আমাদের রক্তে চৈতন্যে দুঃখের বিষবৃক্ষ, প্রদোষে প্রাক্কালে কেবলই নিষ্ঠুর সান্ত্বনা।

ত্বকী ‘ফিরে এসো বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি কবিতায় লিখেছে, ‘যুদ্ধের সেই সব নায়করা/ ডাক দিয়ে যায়-/ জাতির জন্য, জেগে ওঠার জন্য/ ওই জাতির জন্য; যারা ধ্বংসের মধ্যেও/ নতুন জীবনের ডাক দিয়ে যায়;/ তুমি কি শুনতে পাও/ সেই সব শহীদদের কণ্ঠস্বর/ যা প্রতিধ্বনি হচ্ছে বহু দিন ধরে?’ সে কণ্ঠস্বর হয়তো আমরা কেউ শুনতে পাই, কেউবা পাই না। কিন্তু ত্বকী তা শুনতে পেয়েছিল। আর তাই নির্ভয়ে বলতে পেরেছিল, ভয় কিসের? দ্বিধা কেন মৃত্যুতে? কিন্তু আমরা তো এর প্রতিকার চাই। যুদ্ধের সেই নায়কদের, শহীদদের প্রতি প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চাই। এ পাপ থেকে পরিত্রাণ চাই। নয়তো সে পাপে নীলকণ্ঠ থেকে তো উচ্চারিত হতেই থাকবে, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!/ ...দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে/ অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।’

রফিউর রাব্বি: তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর বাবা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব