পুকুর-দিঘির দেশের উগান্ডাযাত্রা

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

১৮ লাখ দিঘির দেশ বাংলাদেশ। নদী গড়েছে দেশ আর পুকুর গড়েছে গ্রাম-শহর। মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার স্নানঘর, পাকা কুয়া, ইট বাঁধানো পুকুরই প্রমাণ করে ইতিহাসের পথ। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ‘সুদর্শন হ্রদ’ থেকে চব্বিশ পরগনার ‘চন্দ্রকেতুর গড়’ হয়ে মহাস্থানগড় পর্যন্ত দিঘি-পুকুরময় শহরের কথা স্মরণে বিরাজে।

পুকুরপাড়ে গড়ে উঠেছে তীর্থকেন্দ্র। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-সরস্বতী যেখানে ছিল না, সেখানে পুকুর-দিঘিই ছিল তীর্থকেন্দ্র। মধুপুর বনের ‘বারো তীর্থ’ এমনই একটি জলাশয়। খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীতে নৃপতি ভগদত্ত বারোটি তীর্থের জল এনে এটি গড়ে তোলেন। যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসেবেও পুকুর খনন হয়েছিল। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত-এ আছে কৈবর্ত বিদ্রোহের সেনাপতির নামে ‘দিব্যোক দিঘি’র ইতিহাস।

শত শত পুকুর ছিল প্রতিটি শহরে। গুপ্ত, পাল ও সেন যুগ ধরে পঞ্চগড়ের ভিতরগড় ও বোদেশ্বরী, দিনাজপুরের বারপাইকেরগড় ও ঘোড়াঘাট, রংপুরের কাটাদুয়ার, গাইবান্ধার বিরাটনগর ও যোগদহ, বগুড়ার মহাস্থানগড়সহ যেসব দুর্গনগরী গড়ে উঠেছিল, সব কটিতে বিশাল বিশাল দিঘি ছিল। নওগাঁর আলতাদিঘি, কালিসাগর ও ছয়ঘাটির দিঘি; ঠাকুরগাঁওয়ের ভাঙ্গাদিঘি, সসরাদিঘি ও পেয়ালদিঘি; সিরাজগঞ্জের জয়সাগর; নীলফামারীর বিন্নার দিঘি বা নীলসাগর; বগুড়ার শশাঙ্ক দিঘি ও শবদল দিঘি; পঞ্চগড়ের ভিতরগড় দিঘি, রংপুরের জলচ্ছত্রসহ হাজার হাজার বিখ্যাত দিঘির শহরগুলোকে গড়েছে।

সুলতানি ও মোগল আমলেও হাজার হাজার দিঘি খনন করা হয়। শুধু রাজশাহী নগরেই ছিল তিন শতাধিক পুকুর। ধলসমুদ্র, বলভা দিঘি, বিলাসপুর দিঘি, মালসীন দিঘি, গুরমা দিঘি, আমসাগর, আলুখাঁর দিঘি, শীতলাই দিঘি ও ভানু সিংহের দিঘি উল্লেখযোগ্য। তাড়াশ নামের উপজেলাতেই আছে ৩০০ পুকুর। তারই পাশে সমাজ গ্রামে নোয়াবাড়ির দিঘি ও শরিফখান দিঘির মতো প্রাচীন শ পাঁচেক দিঘি আছে। ৪০০ বছরের প্রাচীন পাঙ্গাই দিঘি আছে বড়াইগ্রাম ও চাটমোহরের মাঝামাঝি আটুয়া গ্রামে। মান্দ উপজেলার কালীগ্রামে আছে ৮০টির অধিক দিঘি। বাগেরহাটের খানজাহান আলী নিজেই ৩৬০টি দিঘি খনন করেন। পুরো দেশের ঘটনাই এমন।

দেশজোড়া পুকুর-দিঘিগুলো স্থাপত্য শিল্পেরও নিদর্শন। সমুদ্রতীরবর্তী দিঘিগুলোর পাড় ঢিবির মতো উঁচু ও শক্ত। যাতে লোনাপানি জলোচ্ছ্বাসেও না ঢোকে। আর উত্তরবঙ্গের দিঘিগুলোর পাড় তুলনামূলক নিচু ও নরম। বর্ষার পানি যাতে ঢোকে ও আটকে রাখা যায়। এবং সময়মতো কেটে দিয়ে মাছ প্রবেশ করানো যায়। তা ছাড়া, পুকুরের পানিকে ঠান্ডা ও ধরে রাখা, মিষ্টি রাখা ও শোধন করার জন্য পাড়জুড়ে বিন্না ঘাস ও পানিতে পানাজাতীয় উদ্ভিদের আবাস তৈরি করা হয়। ব্রিটিশ যুগে দিঘি ও পুকুর খনন না হওয়ায় জনগণের এসব জ্ঞান হারিয়ে যায়।

এ ছাড়া ভক্তিকেন্দ্রিক ব্যাপারও আছে। সঙ্গে ছিল বাড়িকে ঠান্ডা রাখার জ্ঞানও। পাল ও সেন আমলজুড়ে সব পুকুর-দিঘি উত্তর-দক্ষিণমুখী করে খনন করা হতো এবং মুসলমান রাজাদের পুকুরগুলো হতো পুবে-পশ্চিমে লম্বা। তবে খানজাহান আলীসহ পীর-মুর্শিদদের দিঘিগুলো উত্তর-দক্ষিণেই লম্বা হতো। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ও তাঁর পুত্র সুলতান নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ যে পুকুরগুলো খনন করেছিলেন, সেগুলোও ছিল উত্তর-দক্ষিণেই লম্বা। তবে ব্যতিক্রমহীনভাবে বাড়ির মুখ থাকত দক্ষিণ দিকে। এতে দরজা-জানালা দিয়ে জলীয় বাষ্পওলা বায়ু প্রবাহিত হতো। আর এই বায়ুতে অক্সিজেনের মাত্রা থাকত বেশি।

 ২.

১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় পানি নীতি হয়। ২৭ পৃষ্ঠার এই পানি নীতিতে পুকুর-দিঘির কথা উল্লেখই নেই। নগর-পরিকল্পনাতে তো থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তাই নগরগুলোতে বিদ্যমান পুকুরগুলো পৌরসভার ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে হইচই করতে গিয়ে যেমন শিয়াল-বানরের বিলুপ্তির কথা ভুলে যাই, তেমনি নদীর কথা বলতে গিয়ে পুকুরের কথা মনেই নেই। নদ-নদী নিয়ে অর্ধশতাধিক বই লেখা হয়েছে, কিন্তু পুকুর-দিঘি নিয়ে মাহবুব সিদ্দিকীর বাংলাদেশের বিলুপ্ত দিঘি-পুষ্করিণী-জলাশয় নামে একখানা মাত্র বই আছে। ব্রিটিশ আমল থেকে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত কোনো দিঘি খনন করা হয়নি। স্থাপনা নির্মাণে মাটি ভরাট করতে গিয়ে প্রতিক্রিয়া হিসেবে পুকুর তৈরি হয়েছে। সড়ক, মহাসড়ক, রেললাইন, হেলিপ্যাড, শহর বানাতে গিয়ে পুকুর তৈরি হয়েছে। ফলে এসব নির্মাণকাজের জন্য পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে, পাশে পুকুর সৃষ্টি হওয়ায় সেই ক্ষতি কিছুটা পূরণ হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এই মাটি ভরাটের কাজটি হয় নদ-নদী জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে বালু উত্তোলনের মাধ্যমে। এমনকি বিদ্যমান পুকুর-দিঘিগুলোও ভরাট হচ্ছে এভাবে।

আজ রাজশাহী শহরের পরিবেশ নিয়ে সবাই তিনজন মেয়রকে কৃতিত্ব দেয়। প্রকৃত কারণ কিন্তু ভিন্ন। ২০১০ সালের একটি রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রাজশাহী শহরের সব জলাশয় ভরাট নিষিদ্ধ করে দেন। রিটের বাদী ছিলেন বাংলাদেশের বিলুপ্ত দিঘি-পুষ্করিণী-জলাশয় গ্রন্থের লেখক মাহবুব সিদ্দিকী। ফলে রাজশাহী সিটি করপোরেশন ১৬৫টি পুকুর-দিঘির তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠায় ও সংরক্ষণে বাধ্য হয়। ইতিহাসে শুধু রাজাদেরই নাম পাওয়া যাবে।

দিঘি-পুকুরের দেশের আমলারা পুকুর খননের জ্ঞানার্জনে ছুটছেন সুদূর উগান্ডা দেশে! বন ধ্বংস করে যেমন গাছ লাগানো, তেমনি পুকুর-দিঘি রক্ষার চেয়ে খনন বেশি লাভজনক। যে উগান্ডা আমাদের গন্তব্য, সেই উগান্ডায় মানুষ পানির অভাবে মরে। তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী?

‘দুয়ারে এঁকেছি রক্তরেখায় পদ্ম-আসন,/সে তোমারে কিছু বলে?’

৩০ লাখ শহীদের রক্ত কি কিছু বলে?

নাহিদ হাসান: রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি
[email protected]