এই বিক্ষোভের পরিণতি কী হতে পারে?

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

ইরাকের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সরকার দেশটির নাগরিকদের নিম্নতম মৌলিক চাহিদা ও সেবা এবং নিরাপত্তা দিতে পারছে না। হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর রাস্তায় নেমে আসা এবং তাদের প্রতি সমাজের বেশির ভাগ মানুষের সমর্থন দেওয়ার এটিই প্রধান কারণ। সুদীর্ঘ দিনের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও হানাহানিকে ১৬ বছর ধরে রাজনীতিকেরা যেভাবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছেন, সেটিই মূলত মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছে।

বিক্ষোভকারীদের বেশির ভাগই তরুণ ইরাকি এবং দেশটির বর্তমান রাজনীতির বাইরে তারা কিছু জানে না। তাদের বেশির ভাগেরই সাদ্দাম হোসেনের আমলের কথা মনে নেই। এমনকি সাদ্দামের শাসনামলে অনেকের জন্মও হয়নি। বিক্ষোভকারীরা মর্যাদাপূর্ণ জীবন, গোষ্ঠী বিবাদ ও ইরাকি রাজনীতিতে ইরানের হস্তক্ষেপের অবসানের দাবি জানাচ্ছে। ‘মর্যাদাহীন জীবনের বদলে শাহাদত বেছে নেব’, ‘আমার বেতন মাসে মাত্র আট ডলার কেন?’ , ‘কোনো শিয়া-সুন্নি বিভাজন চলবে না’—তরুণ বিক্ষোভকারীরা এসব স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে।

তাদের ক্ষোভ সরাসরি বর্তমান প্রশাসন কিংবা ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদেল মাহাদির ওপর নয়। তারা গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপরই ক্ষুব্ধ। তারা দেখছে একের পর এক নির্বাচন হচ্ছে এবং নতুন নতুন নেতা ক্ষমতায় বসছেন কিন্তু নাগরিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসছে না।

যেকোনো রাজনীতি বিশ্লেষকের পক্ষেই এই বিক্ষোভের পূর্বাভাস দেওয়া সহজ ছিল। কারণ, দিন দিন মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। বিক্ষোভকারীদের দমন করতে গত কয়েক দিনে নিরাপত্তাকর্মীরা যেসব অভিযান চালিয়েছেন, তাতে কমপক্ষে ৯৩ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে চার হাজারের বেশি মানুষ। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

এ বিক্ষোভ যদি সরকার নিয়ন্ত্রণে নিয়েও নেয়, তাহলেও খুব শিগগির আবার তা জেগে উঠবে। আরেকটি নির্বাচন এবং আরেকটি নতুন সরকার এই গভীর শিকড় গেড়ে বসা সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। আগামী কয়েক দিনে বিক্ষোভের ফল হিসেবে কয়েকটি দৃশ্য সামনে আসতে পারে।

প্রথমত, সরকার চাপে পড়ে বিক্ষোভকারীদের সংস্কারের গতানুগতিক প্রতিশ্রুতি দিতে পারে এবং নতুন নির্বাচন দেওয়ার অঙ্গীকার করতে পারে। দুর্নীতি দমনের ফাঁকা আওয়াজ দেওয়া হতে পারে। কিন্তু এসব পদক্ষেপ নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষের ক্ষোভ প্রশমন করা যাবে না। কারণ, ইরাকের ত্রুটিপূর্ণ সংবিধান এবং অর্থ ও অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখলের রেওয়াজ দেখে তারা চূড়ান্ত রকমের হতাশ হয়ে আছে।

 দ্বিতীয় যে দৃশ্যের অবতারণা হতে পারে, সেটি হলো সহিংসতা তীব্র মাত্রায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিক্ষোভকারীদের ওপর বেসামরিক মিলিশিয়ারা হামলে পড়তে পারে। ইরাকের নিরাপত্তাব্যবস্থা শুধু পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হাতে নয়। বহু অস্ত্রধারী গ্রুপ আছে, যারা সরকারের হয়ে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখে। এই গ্রুপগুলো
নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর উৎপীড়ন চালানো শুরু করতে পারে। তবে এটি শুরু হলে তরুণেরা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। তাদের পক্ষে তখন রাষ্ট্রের
বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা ছাড়া কোনো পথ খোলা থাকবে না। বিশেষ করে আনবার ও নিনিভেহ প্রদেশে এ ধরনের ঝুঁকি বেশি। এটি হলে বড় মাত্রায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে।

তৃতীয় যে অবস্থাটি তৈরি হতে পারে বলে মনে করা হয়, সেটি হলো সেনা অভ্যুত্থান। ইরাকের হতাশ হয়ে পড়া প্রবীণেরা এবং কিছু তরুণ চায় সেনাবাহিনী ক্ষমা গ্রহণ করুক। তারা বড় ধরনের সংস্কার পদক্ষেপ নিতে পারবে বলে এই নাগরিকেরা মনে করে। তবে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান ঘটানোর সম্ভাবনা খুব জোরালো নয়। ইরাকে সেনাবাহিনীকে বরাবরই শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। এ কারণে সেনা কর্মকর্তারা শাসনভার নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ার ঝুঁকি না–ও নিতে পারেন।

চতুর্থত যে বিষয়টি ঘটতে পারে, তা হলো একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন। এই সরকার গঠনের পর তারা যদি বিশদ আকারে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালায় এবং পরে জাতীয় সংলাপের মধ্য দিয়ে একটি দুর্নীতিমুক্ত নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারে, তাহলে হয়তো একটি আশাবহ অবস্থানে পৌঁছানো যেতে পারে।

ইরাকের অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করতে হলে সবার আগে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে হবে। শিয়া-সুন্নি বৈষম্য কমাতে হবে। এই বৈষম্য থাকলে ইরাকের ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব হবে না। এই অতি দুরূহ কাজটি রাজনীতিকদের পক্ষেই করা সম্ভব। কিন্তু নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে সে বিষয়ে আগ্রহ কম। এটিই দুর্ভাগ্যের বিষয়।

দ্য ন্যাশনাল থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
মিনা আল ওরাইবি: ইরাকের সাংবাদিক ও লেখক