কেন এই নিষ্ঠুরতা?

আবরার ফাহাদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
আবরার ফাহাদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রথম আলোয় খবরটা পড়ার পর সারা দিন আর কাজে মন বসাতে পারিনি। বাংলা লেখার চর্চা নেই দীর্ঘদিন। মায়ের ভাষা ছাড়া কি বুকভরা কষ্টের কথা লেখা যায়? আবরার ছেলেটা আমার নিজের ছেলের কাছাকাছি বয়সের। আহা কী নিষ্পাপ চেহারা! মা–বাবা কত স্বপ্ন নিয়ে না ছেলেটাকে বড় করেছেন। বাংলাদেশের কটা ছেলে একসঙ্গে বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়! কী অন্যায় করছিল সে? এত নিষ্ঠুর কি করে বুয়েটের ছেলেরা হতে পারে! বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্র, শিক্ষক, শেরেবাংলা হলেরই প্রাক্তন আবাসিক ছাত্র হিসেবে, একজন বাবা হিসেবে, আর সর্বোপরি একজন মানুষ হিসেবে এই নির্মমতা কীভাবে সহ্য করি? যে ছেলেগুলো এই নৃশংস কাজটা করল, তারা কি মানুষ হিসেবে দুনিয়াতে এসেছে?

আবরারকে যারা পিটিয়ে মেরে ফেলল, তাদের মা–বাবারা কি খুনি হওয়ার জন্য তাদের কষ্ট করে বড় করেছে? অভিভাবকেরা তো অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পাঠিয়েছে। তারা কেন দানবে পরিণত হলো? তাদের কাজ তো পড়াশোনা করে সময়মতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে আরও উচ্চশিক্ষা নিয়ে অথবা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে প্রতিভার সদ্ব্যবহার করা। ফেসবুক পুলিশ হওয়ার দায়িত্ব কে তাদের দিয়েছে? বাংলাদেশ কি স্বাধীন দেশ নয়? এই দেশে কেন একটা বুদ্ধিমান ছেলে মতপ্রকাশ করতে পারবে না? সে তো কাউকে গালি দেয়নি। তার বক্তব্যে তো কোনো অযৌক্তিক কথা নেই। কোনো আইনে লেখা আছে যে বিদেশনীতির সমালোচনা করা যাবে না?

বলা হচ্ছে বা হবে ‘ছেলেটিকে শিবির সন্দেহে জেরা করা হচ্ছিল’। আমি জানি না আইন করে বাংলাদেশে শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে কি না। যদি ছেলেটি নিষিদ্ধ কোনো দলের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে, তাহলে তা দেখার দায়িত্ব তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। মারধর তো দূরের কথা, একজন মানুষের গায়ে হাত তোলাই তো বিরাট অপরাধ।

এই সমাজবিরোধী ছেলেগুলোর যাঁরা অভিভাবক, তাঁদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, আপনাদের সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য তৈরি করেছেন, মানুষ হওয়ার শিক্ষা কি দিতে পেরেছেন?

আপনার সন্তান এখন খুনের দায়ে অভিযুক্ত আর আপনি তাঁর অভিভাবক। ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েই কি দায়িত্ব শেষ? ছেলেটি কার সঙ্গে মেলামেশা করে, পড়াশোনা ঠিকমতো করে কি না, তার কি খোঁজ রাখেন? একটা ২০–২২ বছর বয়সের ছেলে বা মেয়ে কিন্তু অনেকটাই অপরিপক্ব। বাবা-মার দায়িত্ব কিন্তু সন্তানের খোঁজখবর নেওয়া আর অন্যায় করা থেকে তাদের বিরত রাখার চেষ্টা করা।

যেসব ছাত্র সেদিন হলে ছিল, তাদের কাছে জানতে ইচ্ছা করে একটা ছেলেকে দীর্ঘ সময় ধরে অত্যাচার করা হলো আর কেউ সেটা শুনতে পায়নি, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? যাদের সামনে থেকে আবরারকে ধরে নিয়ে গেল, তারা কোনো দায়িত্ববোধ করল না? 'ভাইয়াদের' যারা ভাইয়া, তাদের কেন খবর দিলে না? বিশ্ববিদ্যালয়ে কি প্রশাসন নেই? প্রভোস্ট বা ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা কি খুব কঠিন ছিল?

বুয়েটের শিক্ষক, হল প্রভোস্ট, ছাত্রকল্যাণ পরিচালক, উপাচার্য তাঁরা কি এই ঘটনার দায় এড়াতে পারেন? হলের রুমে রান্না করার হিটার থাকলে তার খবর প্রভোস্টের কাছে চলে যায় কিন্তু টর্চার সেলের খবর তাঁর কাছে থাকবে না এটা কী করে হয়। আর এখন 'টর্চার চেম্বার'–এর খবর তাঁরা জানেন না তা কী করে হয়? আপনারা কি এই হাজার পাঁচেক ছেলেমেয়ের অভিভাবক নন? মফস্বল শহর বা গ্রাম থেকে বাবা-মা তো আপনাদের ভরসায় তাঁদের সন্তানটাকে পাঠান। এদের নিরাপত্তা দেওয়া আর মনুষ্যত্বের শিক্ষা দেওয়ার দায় কিন্তু আপনাদের ওপরও কিছুটা বর্তায়।

যারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক হর্তাকর্তা, তাঁদের কাছে প্রশ্ন, শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত রাখলে কি বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে? বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। তাহলে দিন না ছাত্রদের পড়াশোনা করতে।

জসিম ইমরান: বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলাইনার অধ্যাপক। এই মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব।