ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ও পয়সার ওপিঠ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরে ভারতের সঙ্গে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। ছবি: পিআইডি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরে ভারতের সঙ্গে সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। ছবি: পিআইডি

ভারতের রাজধানীতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে আন্তরিকতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা জানিয়েছেন, তাতে প্রীত হওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে। ভারত আমাদের সবচেয়ে বৃহৎ প্রতিবেশী, বাণিজ্য থেকে জাতীয় নিরাপত্তা, অনেক প্রশ্নেই এই দেশটির ওপর আমাদের নির্ভরশীল থাকতে হয়। নদীর পানি থেকে পেঁয়াজ, সব ব্যাপারেই আমরা ভারতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ফলে সমতার সম্পর্ক নিয়ে যত কথাই বলি না কেন, ভারতের ইতিবাচক মনোভাবের ওপর আমাদের অনেকটাই নির্ভরশীল হতে হয়।

সফর শেষে দুই দেশ যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে, তাতে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার বিস্তর ভালো কথা রয়েছে, যা শুনে বাংলাদেশের আশ্বস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে এই বিবৃতি যদি কিছুটা ভেঙে দেখা যায়, তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ যে একেবারে নেই, তা নয়।

বাংলাদেশ ও ভারতের চলতি সম্পর্কে একটি বড় বাধা বাণিজ্যিক অসাম্য। আমরা ভারতে খুব সামান্যই রপ্তানি করি, বড়জোর ৬০০ বা ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের মতো পণ্য। অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানির পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এই অসাম্য দূর করা নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে অনেক সময় অনেক কথা শোনা গেছে, শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানির দাবিও জানানো হয়েছে। কোনো কাজ হয়নি, বরং উল্টো বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে ভারত। গত বছর ঢাকায় আয়োজিত এক সেমিনারে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে রপ্তানি করে এমন অনেক পণ্য রয়েছে, যা ভারত বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করলেও বাংলাদেশ থেকে করে না। অব্যাহত অসমান্তরাল বাণিজ্যের ফলে বাংলাদেশের বাজার ভারতীয় পণ্যে সয়লাব। অনুমান করি শীর্ষ বৈঠকের সময় এই দুই নেতা বাণিজ্যের প্রশ্নটি বিবেচনায় এনেছেন, কিন্তু যৌথ বিবৃতিতে সে কথার কোনো প্রতিফলন নেই।

আলোচনার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল পানিবণ্টন। এই প্রশ্নে মতভেদ স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে এক মস্ত ক্ষত। আমরা ভাটির দেশ, আমাদের ব্যবহৃত পানির প্রায় ৯০ শতাংশ আসে উজান থেকে। ভারত সে পানির রক্ষক, আমাদের কথা ভাবার আগে সে নিজের কথাই ভাবে। তার সঙ্গে চেঁচিয়ে-হল্লা পাকিয়ে কোনো কাজ হবে না, এটা আমরা ঠেকে শিখেছি। শুধু ভারত কেন, চীন, নেপাল বা ভুটান, যারা আমাদের দেশে প্রবাহিত নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে, তারা কেউই বাংলাদেশের স্বার্থ মাথায় রাখার প্রয়োজন দেখে না। ফারাক্কা নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি হয়েছে বটে, কিন্তু ফারাক্কা বাঁধ নির্মিত হওয়ার পর। মেঘনার উজানে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও কোনো রা করতে পারিনি আমরা। একই কথা তিস্তা বাঁধ নিয়ে।

বাংলাদেশের জন্য আরও বড় দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে যদি আমাদের সম্মতি ও অংশগ্রহণ ছাড়া ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার উন্নয়ন ও ভারতের আন্তনদী–সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। মোদি সরকার যুক্তি দেখিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র ও পূর্ব ভারতের গঙ্গা অববাহিকা থেকে পানি স্থানান্তরের লক্ষ্যে যদি বিপুলসংখ্যক বাঁধ, ক্যানাল ও জলাধার নির্মাণ সম্ভব হয়, তাহলে বছর বছর ভারতে যে খরা দেখা দেয়, তা চিরতরে মেটানো সম্ভব। কিন্তু এর ফলে যে আমাদের বারোটা বেজে যাবে, সেটা উপলব্ধি করে আমরা চেষ্টায় আছি বড় ভাইকে অনুনয়-বিনয় করে আমাদের বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে।

আন্তনদী–সংযোগ নিয়ে কী কথা হয়েছে জানি না, তবে মোট সাতটি অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের প্রশ্নে দুই দেশ একটি আলোচনা কাঠামোতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ এটিকে একটি সুখবর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের প্রশ্নটি ঝুলেই আছে। এই সফরের অ্যাজেন্ডায় তা রাখাই হয়নি। সমস্যাটি অনেক আগেই সমাধান হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বাগড়া দেওয়ায় এই প্রশ্নে চুক্তি আটকে আছে বলে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি আশ্বাস দিয়েছেন, হবে, এই সমস্যার সমাধান হবে। কীভাবে, সে গোমর তিনি খোলাসা করেননি। বাংলাদেশ অবশ্য চেষ্টার কমতি রাখছে না। মমতাদিকে খুশি রাখতে এবারের পূজায় কয়েক শ টন ইলিশ মাছ পাঠানো হয়েছে, তবে তাতে মন ভজবে, সে কথার কোনো ইঙ্গিত এখন পর্যন্ত মেলেনি।

তিস্তার পানি প্রশ্নে কোনো সমাধান হোক বা না হোক, ভারত কিন্তু ফেনী নদী থেকে পানি নেওয়ার ব্যাপারে আমাদের সম্মতি আদায় করে নিয়েছে। এই পানি অনেক দিন থেকেই যাচ্ছে, নদীর গভীরে পাইপ বসিয়ে আমাদের চোখের আড়ালে পানি চলে যাচ্ছে। ফলে শুকিয়ে যাচ্ছে এই নদী, স্থানীয় কৃষকেরা অনেক আগে থেকেই এ নিয়ে অভিযোগ করছেন। কিন্তু ওপারে, ত্রিপুরার কোনো কোনো অঞ্চলে পানির সংকট তীব্র, অতএব ‘মানবিক কারণে’ বাংলাদেশ ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক সুপেয় পানি সরবরাহে সম্মত হয়েছে। শুনেছি, মমতাদিকে নরম করতেই নাকি এই ‘মানবিক’ সিদ্ধান্ত, তাতে আমাদের সংকট যদি বাড়ে, তাতেও ‘নো প্রবলেম’।

আসামের নাগরিক তালিকা প্রশ্নেও বাংলাদেশ ‘নো প্রবলেম’ বলে জানিয়ে দিয়েছে। নতুন যে নাগরিক তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে, তাতে এক আসামের প্রায় ২০ লাখ ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশি অভিহিত করে তাদের সীমান্তের ওপারে পাঠানোর পাঁয়তারা চলছে। এ নিয়ে হাসিনা-মোদি বিস্তারিত কথা বলেছেন বলে জানানো হয়েছে। মোদিজি জানিয়েছেন, বাংলাদেশকে ‘এই মুহূর্তে’ (!) উদ্বিগ্ন হতে হবে না। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে, তাঁর সরকার কেবল সেই নির্দেশ বাস্তবায়িত করছে। অথচ মাত্র এক সপ্তাহ আগেই এক জনসভায় বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ ফের জানিয়েছেন, অবৈধ চিহ্নিত প্রতিটি মানুষকে ঠেলে বাংলাদেশে পাঠানো হবে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীকে এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলে দ্য হিন্দু পত্রিকাকে তিনি বলেছেন, ভারতীয় রাজনীতিকেরা কখন কাকে কী বলেন, তা নিয়ে বাংলাদেশের কোনো মাথাব্যথা নেই। প্রধানমন্ত্রী নিজে আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, আমরা তাতেই সন্তুষ্ট। খুব সোজাসাপ্টা কথা, কিন্তু সোজাসাপ্টা কথার ফাঁকে একটি আলগা কথাও বলে ফেলেছেন গওহর রিজভী।

তিনি জানিয়েছেন, নাগরিক তালিকা নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। সে প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর যদি দেখা যায় কিছু লোক আসলেই বাংলাদেশের, তাহলে তাদের ফেরত নেওয়া হবে। ১০ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের লেজেগোবরে অবস্থা, তার ওপর আরও ১৫–২০ লাখ ভারতীয়! ভাসানচরে এত লোকের জায়গা হবে তো?

বলাই বাহুল্য, এই সফরকালেও রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারতকে বাংলাদেশ নিজের পাশে পায়নি। জাতিসংঘে বা তার বাইরে ভারতের গলায় যে সুর শোনা গেছে, তাতে রোহিঙ্গা গণহত্যার নিন্দার বদলে মিয়ানমারের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল বক্তব্যই এসেছে। কারণটা আমরা জানি, ভারত চায় না মিয়ানমারে চীন একা আসন গেড়ে বসুক। তা ছাড়া, মানবাধিকার রক্ষার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি বাণিজ্য স্বার্থ রক্ষা। আমরা নিশ্চিত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমস্যার গভীরতা বুঝিয়ে বলেছেন। জবাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু মুখের কথায় গুরুত্ব আরোপ করলেই তো হবে না, মিয়ানমারের আধা সামরিক সরকারের ওপর অর্থপূর্ণ চাপ দিতে হবে। ভারত সে কাজে নারাজ।

এই সফরে দুই দেশের আলোচনার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল সমুদ্র উপকূলীয় নিরাপত্তা ও নজরদারি। এই প্রশ্নে দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তার ফলে ভারত বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে একটি অত্যাধুনিক রাডার ব্যবস্থা স্থাপন করবে। লক্ষ্য, বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নজরদারি করা। ঠিক কার আক্রমণের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এই নজরদারি? এই রাডার ব্যবস্থার কলকাঠি থাকবে কার হাতে? সমঝোতা স্মারকের ভাষা থেকে সে কথা বোঝা অসম্ভব, তবে আক্কেলমন্দদের ধারণা, হুমকি বলতে চীনকেই বোঝানো হচ্ছে। বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে রাডার কিনবে, তা বলা হয়নি, অতএব আমরা অনুমান করতে পারি তার নিয়ন্ত্রণ থাকবে ভারতের হাতে। বিষয়টি যদি আমরা সাধারণ মানুষেরা এত সহজেই বুঝে ফেলি, তাহলে চীনও যে বুঝবে, তাতে সন্দেহ নেই। আমরা তো ভেবেছিলাম ভারতকে ঠেকাতে ‘চীনা তাস’ ব্যবহারের পথ খুঁজছে বাংলাদেশ। কিন্তু সে চীনা তাসের যে এই অর্থ, তা তো আমরা বুঝিনি।

বাংলাদেশ ও ভারত দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ, কিন্তু তাদের সম্পর্ক সমতার ভিত্তিতে স্থাপিত, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। এই সফরে সে কথা আবারও বোঝা গেল। বস্তুত এই দুই দেশের আয়তন ও ওজনের মধ্যে ফারাক এত বিপুল যে কোনো রকম অর্থপূর্ণ সমতা আশা করাও বোকামি। সেটা সম্ভব শুধু তখনই, যখন ‘বড় ভাই’ ভারত নিজ থেকে সে সমতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবে। ভারতের ইতিহাসে শুধু একজনই সে প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিলেন, প্রতিবেশীর প্রতি যথার্থ বন্ধুর হাত বাড়িয়েছিলেন। তিনি আই কে গুজরাল, যিনি প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কোনো শর্ত ছাড়াই বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বের আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি যে ‘গুজরাল ডকট্রিন’ অনুসরণ করেছিলেন, তার মূল কথাই ছিল বৃহৎ দেশ ‘বড় ভাই’ হিসেবে ভারতকে বৃহৎ হৃদয়ের অধিকারী হতে হবে। কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘আমি কী পেলাম’ এই শর্ত সে আরোপ করবে না।

ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন, এ কথায় কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি আই কে গুজরাল নন।

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক