উপাচার্যের ব্যর্থতায় আমরা মর্মাহত

অধ্যাপক ড. এ কে এম মাসুদ
অধ্যাপক ড. এ কে এম মাসুদ
>

অধ্যাপক ড. এ কে এম মাসুদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক সমিতির বর্তমান সভাপতি ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন বিভাগের শিক্ষক। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন আবরার হত্যাকাণ্ড ও বুয়েটের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে। 

প্রথম আলো: বুয়েটে এই নৃশংসতম খুনের পটভূমি কী?

এ কে এম মাসুদ: সবচেয়ে মেধাবীরা বুয়েটে ভর্তি হন, কিন্তু ক্যাম্পাসে এসে কিছু শিক্ষার্থীর নৈতিক অবক্ষয় ঘটে। তাঁদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব শিক্ষক ও প্রশাসনের। তাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে দিনে দিনে এমন সহিংসতা বেড়েছে। ডিসিপ্লিনারি রুলস সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়নি।

প্রথম আলো: সমিতির বিবৃতিতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছেন, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীন?

এ কে এম মাসুদ: নিরাপত্তাহীনতা চলেই আসছিল। এটা এক দিনে আসেনি। আগে যদি কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিত, তাহলে আজকের পরিস্থিতি দেখতে হতো না।

প্রথম আলো: বর্তমান ভিসি শৃঙ্খলা কমিটিরও সভাপতি। বলা হয়, তিনি মেধাবী কিন্তু প্রশাসনিকভাবে ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার সঙ্গে ছাত্রদের অসদাচরণ রোধ করতে না পারার সম্পর্ক আছে?

এ কে এম মাসুদ: অবশ্যই আছে। তাঁকে আমরা স্বাগত জানিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁর প্রশাসনিক ব্যর্থতায় আমরা মর্মাহত। গত ৩০ জুন সমিতির রেজল্যুশন বলেছে, বেশির ভাগ ফাইল সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এক থেকে দুই বছর পড়ে থাকে। প্রশাসন স্থবির। প্রভাষক নিয়োগ দিতে সেমিস্টার শেষ হয়ে যায়। উপাচার্য নিয়মিতভাবে দুপুর সাড়ে ১২টার পর অফিসে আসেন। একাডেমিক কাউন্সিলের সভা হয় না। সাড়ে তিন বছরে মাত্র ১৪টি সিন্ডিকেট সভা করেছেন তিনি। তাঁর প্রশাসনিক অদক্ষতায় সাড়ে ২৪ কোটি টাকার তহবিল ফেরত যায়। তাঁরই অন্যায্য সিদ্ধান্তে ২১ জন শিক্ষক ও ২২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেনশন আটকে যায়। হাইকোর্ট, আপিল বিভাগে ও রিভিউতে হেরে যাওয়ার পরও তিনি সহজে রায় মেনে নিতে চাননি। দুই বছর ধরে ভুক্তভোগী শিক্ষক-কর্মচারীরা অমানবিক জীবন যাপন করেছেন।

প্রথম আলো: এটা কি সত্য যে, হত্যাকাণ্ডের পরদিন ভিসি ১১টায় সভা ডেকেও সাড়ে ১২টায় হাজির হয়েছেন?

এ কে এম মাসুদ: সত্যি। এতে উপস্থিত শিক্ষকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী ভিসির ২৪ ঘণ্টা ক্যাম্পাসে থাকার কথা। কিন্তু তিনি থাকেন লালবাগে নিজের বাসায়।

প্রথম আলো: উপাচার্যের বিরুদ্ধে তিন বছরে অন্তত ২৩ বা ৩৩ বার বিদেশে যাওয়ার অভিযোগ কতটুকু সত্য? অথবা কাজ না করে কনসালটেশন ফির প্রত্যাশা, যা সিন্ডিকেট নাকচ করেছে?

এ কে এম মাসুদ: তিনি আড়াই বছরে অন্তত ২২ বার বিদেশভ্রমণে গেছেন। ফির বিষয়টি তিনি নিজে দাবি করেননি, করেছেন ব্যুরো অব রিসার্চ অ্যান্ড টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেশনের পরিচালক। সেটা অনুচিত। কাজ না করে শুধু পদাধিকারবলে পারিতোষিক ( .২৫ শতাংশ) আশা করা অনৈতিক।

প্রথম আলো: গত ডিসেম্বরে তিন সাংবাদিককে ছাত্রলীগ মারল। আবার দুই সপ্তাহে চুল কাটেনি বলে অভিজিৎ করের কানের পর্দা ফাটাল একই সংগঠনের সৌমিত্র লাহিড়ী। সৌমিত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আবার অন্য ঘটনায় দুজনকে হল থেকে বহিষ্কার করা হলেও তাঁদের হলে দেখা যায়।

এ কে এম মাসুদ: নির্দিষ্ট কোনো ঘটনা নিয়ে নয়, সাধারণভাবে বলব, সাম্প্রতিক কালে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থাগুলো লোকদেখানো। যদি দৃষ্টান্তমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হতো, তবে র‌্যাগিংয়ের মতো সহিংসতা কমে আসত। আমরা কাউন্সেলিং করতে পারতাম। সেটাও আমাদের কাজ। কিছুই তো হয়নি।

প্রথম আলো: একজন তরুণ শিক্ষক আমাদের বুয়েট পরিস্থিতির জন্য ক্ষমতার রাজনীতিকে দায়ী করেছেন। অন্য একজন বলেছেন, এটা জাতীয় রুগ্‌ণ রাজনীতির বিস্তার। বুয়েট দলাদলি ও বিভক্তি থেকে অনেকটা মুক্ত, কিন্তু পরিস্থিতি এত খারাপ হলো কী করে?

এ কে এম মাসুদ: পাওয়ার পলিটিকস তো ওপরের বিষয়। রুগ্‌ণ রাজনীতির ছাপ আছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমি বুয়েট প্রশাসনকেই দায়ী করব। তারা আগে থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি বলেই আজ এমনটা আমাদের দেখতে হলো। প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণেই হলগুলোতে সহিংসতার বিস্তার ঘটেছে। মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সন্ত্রাস।

প্রথম আলো: ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার কারণেই এই হত্যাকাণ্ড?

এ কে এম মাসুদ: এটা একটা স্ট্যাটাস-বিষয়ক হলেও আমরা জানি যে যাঁদের ভিন্নমত রয়েছে, তাঁদের হলে বিভিন্ন রুমে ডাকা হয়। এখন জানতে পারছি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে টর্চার করা হয়। ফেসবুকে স্ট্যাটাস মনিটর করা হয়। এসব সমস্যা প্রশাসন থেকে দেখা উচিত ছিল।

প্রথম আলো: তার মানে আপনি বলছেন যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও এখন র‍্যাগিংয়ের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে?

এ কে এম মাসুদ: পানি (ফেনী নদীর) নিয়ে যে কথাটা হচ্ছে, এসেছে সেটা কিন্তু সর্বত্রই। এটা নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন বলেই আমাদের ছাত্র মরলেন, তা নয়, এটা একটা কালচারের অংশ হিসেবে ঘটেছে। কারণ, এইটুকু মতের জন্য পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে, তার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি পাই না। এটার পেছনে যে সংস্কৃতি, সেটা হলো যে কাউকে কোনো কিছুর জন্য ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা। এবং সেটাই ধীরে ধীরে আজকে এই নৃশংসতম পর্যায়ে এসে ঠেকেছে।

প্রথম আলো: বুয়েট শিক্ষক সমিতি বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারে না। ক্ষতিপূরণ দেবে বুয়েট? নাকি আমরা হাইকোর্টের রুল পাওয়ার আশা করব?

এ কে এম মাসুদ: নিয়মে নেই। কিন্তু বিভিন্নভাবে আবরারের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব। সেটা দেওয়া উচিত বলে মনে করি।

প্রথম আলো: আজকে সভায় কী সিদ্ধান্ত নেবেন?

এ কে এম মাসুদ: আবরার হত্যাকাণ্ডের পর কী কী করণীয়, কী ধরনের সংস্কার বা সংশোধনের প্রস্তাব করা যায়, সেটাই হবে মূল বিবেচ্য।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

এ কে এম মাসুদ: ধন্যবাদ।