আমার কাছে মোহাম্মদ ফরহাদ

মোহাম্মদ ফরহাদ
মোহাম্মদ ফরহাদ

মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের মৃত্যু হয়। দীর্ঘজীবী ছিলেন না অথচ যাঁদের দীর্ঘদিন বাঁচার দরকার ছিল, তাঁদের সারিতে ছিলেন লেনিন—৫৪ বছর বয়সে মারা যান এবং মুজিব—৫৫ বছর বয়সে। সেই হিসাবে মো. ফরহাদের অকালমৃত্যুকে অস্বাভাবিক মনে না-ও হতে পারে। তারপরও ৩০ বছর ধরে তাঁর মৃত্যুদিবস এলেই মনে হয়েছে, তিনি লেনিন বা মুজিবের মতো আরও কয়েকটি বছর বেঁচে থাকলে পারতেন। তাহলে হয়তো এই ভাঙন ও বিভাজন রোধ করা যেত। তাঁর মৃত্যুর চার বছরের মাথায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। এ দেশেও বাম প্রগতিশীল আন্দোলনের মধ্যে বিপর্যয় দেখা দেয়। একটা বড় অংশের মধ্যে স্বেচ্ছাবিলুপ্তি ঘটে। তিনি থাকলে এ রকম ইচ্ছামৃত্যু হতে দিতেন না। কেননা, তাঁর এক বছর বেশি বাঁচাটা আমাদের এক দশক বাঁচার সমান। আমাদের অনেকেরই বয়স ৬০-৭০ পেরিয়েছে। আমাদের কাছে বাড়তি কিছু প্রত্যাশা নেই কারোর। সমাজবদলের বিপ্লব দূরে থাক, কোনো মঙ্গলকামী সংস্কারও জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমাদের। আমরা কী দিয়েছি পৃথিবীকে? আরও এক দশক বাঁচলেও তাতে বড় একটা কিছু আসে-যায় না সমাজ-পরিপার্শ্বের। আমাদের জন্যই এলিয়ট লিখেছিলেন:

I have lost my passion: why should I need to keep it
Since what is kept must be adulterated?
I have lost my sight, smell, hearing, taste and touch
How should I use them for your closer contact?

কিন্তু মোহাম্মদ ফরহাদের কথা স্বতন্ত্র, তিনি সবার খোঁজখবর রাখতেন, তাঁর ইন্দ্রিয়াদি সজাগ ছিল। তিনি ছিলেন অন্য ধাঁচের মানুষ। লেনিন আর কয়েকটা বছর বাঁচলে সমাজতন্ত্রের নির্মাণটা সম্পূর্ণ অন্যভাবে এগোত। ফরহাদ আর কয়েকটা বছর বেঁচে থাকলে এ দেশের, উপমহাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রাম সম্পূর্ণ অন্যভাবে উঠে দাঁড়াত। বুর্জোয়া দলগুলোর পচনশীলতাও এত দূর গড়াত না। শত কিছুর পরও এই বিশ্বাসটা মনের মধ্য থেকে চলে যায় না।

২.
আমার মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ মানুষের সঙ্গে মো. ফরহাদের খুব বেশি স্মৃতি থাকার কথা নয়। আমি ছিলাম বাম-প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রান্ততম বিন্দুতে দাঁড়ানো আর তিনি ছিলেন বিপ্লবের কেন্দ্রে যুধ্যমান সেনাপতি। সংগঠন যদি ‘অর্কেস্ট্রা’ হয়, তবে তিনি ছিলেন তার মধ্যমণি সঞ্চালক। কিন্তু তাঁর কিছু কিছু সিদ্ধান্ত আবার না আমার মতো, যাঁরা তাঁদের জীবনকে সরাসরি স্পর্শ করেছিল। মস্কোয় যখন আমি মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, তখন দৈববাণী হলো। তাতে তিনটি নির্দেশ: ক. পড়াকালীন এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যাতে করে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। তার মধ্যে পশ্চিমা দেশ থেকে ভোগ্যপণ্য এনে সোভিয়েত দেশের আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমিতে বিক্রি করা যাবে না; খ. পড়াকালে গ্রীষ্মের বা শীতের ছুটিতে পাশ্চাত্যে গিয়ে কাজ করা যাবে না (যথা সিলেটি ভাইদের পরিচালিত লন্ডনের হোটেল-রেস্টুরেন্টে) ও গ. সমগ্র পড়াকালের মধ্যে পাশ্চাত্যে আত্মীয়স্বজনের কাছে ‘একবারের বেশি’ বেড়াতে যাওয়া যাবে না। প্রথম সিদ্ধান্তটি নিয়ে দ্বিমত করার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু দ্বিতীয় এবং বিশেষ করে তৃতীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধল। ৯০ রুবলে মাস চালানো কষ্ট, ফলে ছুটিতে বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারলে বাড়তি কিছুটা আয় হয়। আর পাশ্চাত্যে গিয়ে যে কাজই করি না কেন, সেটা তো শ্রমই, ফলে ন্যায্য মজুরি নিয়ে অবস্থার একটু উন্নতির চেষ্টা করলে ক্ষতি কী? আমার দ্বিতীয় নির্দেশ নিয়েও অত সমস্যা ছিল না। কিন্তু আত্মীয়স্বজন অনেকেই পশ্চিম ইউরোপে থাকেন, ফলে তাঁদের কাছে সমগ্র পাঁচ বছর পড়াশোনার পর্বে ‘একবারের বেশি’ বেড়াতে যেতে পারব না, সেটা কী করে সম্ভব? কিন্তু মোহাম্মদ ফরহাদের স্পষ্ট উত্তর ছিল, ‘দেশের ভেতরে যাঁরা আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন (মনে রাখতে হবে, সেটা জেনারেল জিয়ার কাল) গণতন্ত্রের জন্য, তাঁরা কতটা কষ্টে থেকে এ কাজ করছেন, আর আপনারা রাশিয়ায় এসে কত নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করছেন। এটা বেইনসাফি হয়ে যাচ্ছে না? দেশের কথা ভেবে আপনারা এটুকু কৃচ্ছ্রসাধন করতে পারবেন না?’ একপর্যায়ে এ-ও বললেন, ‘এটা না পারলে দরকার নেই আমার আপনাদের।’ পাতিবুর্জোয়া-মনস্কতার বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির এ রকম হুমকির পর আর তর্ক চলে না। এই নির্দেশগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেই পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরে এসেছি। আজও মাঝেমধ্যে সেদিনের তর্কালাপটির কথা মনে পড়ে। এখন বুঝতে পারি যে শুধু ভালো ছাত্র হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলি, সেটাই তিনি কেবল চাননি; তিনি চেয়েছিলেন আমরা যেন চরিত্রগতভাবেও দৃঢ়চিত্ত হয়ে উঠি। তিনি চেয়েছিলেন আমরা যেন তেজস্বী পাভেল করচাগিনের মতো হয়ে উঠি। প্রলোভন থেকে মুক্ত হতে শিখি। উপনিষদে ‘অভীঃ’ বা ‘ভয়শূন্য’ বিশেষণটি ঈশ্বর বা মানবের প্রতি বারবার প্রযুক্ত হয়েছে। মোহাম্মদ ফরহাদও বলতে পারতেন: ‘অভীঃ’—ভয়শূন্য হও।

৩.
চরিত্রগত দৃঢ়তা একটি বিষয়, কিন্তু শুধু চারিত্রিক-মানসিক গঠনের দৃঢ়তার ওপরই সংগঠন বা আন্দোলন দাঁড়াতে পারে না, এ কথা তাঁর চেয়ে বেশি আর কে জানত। সে জন্যই আশির দশকের মাঝামাঝি তাঁর মনে হয়েছিল, দেশের অগ্রযাত্রার জন্য সম্পদের বণ্টন-সংবেদনশীল (বা ডিস্ট্রিবিউশন-সেনসিটিভ) একটি উন্নয়নকৌশল হাতে নেওয়া প্রয়োজন এবং সে লক্ষ্যে নতুন স্লোগানেরও প্রয়োজন। এর পরিসংখ্যানভিত্তি দাঁড় করানোর জন্য দেশের প্রগতিশীল তরুণ অর্থনীতিবিদদের প্রতি একটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন রাখলেন তিনি। পাকিস্তান আমলের শেষ পর্যায়ে দেশটি যেমন করে দুই অর্থনীতির ফাঁদে পড়ে গিয়েছিল, বাংলাদেশেও সেটি ঘটছে কি না? দেশের একদিকের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে ২২ পরিবারের মতো ৫০০ পরিবারের বাণিজ্যগোষ্ঠী, যাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে দেশের অন্যদিকের আপামর মানুষের অর্থনীতি বা নাগরিক অর্থনীতি। ‘বণিক অর্থনীতি’ আর ‘নাগরিক অর্থনীতি’—এ দুই অর্থনীতির মধ্যে লড়াই আসন্ন—এটাই ছিল মো. ফরহাদের থিসিস। এর জন্য যুক্তিতর্ক ও তথ্যের মালমসলা জোগাড় করতে বললেন তিনি। অচিরেই এর ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে চান—এই ইচ্ছাও জানালেন। ১৯৮৭ সাল নাগাদ এ নিয়ে কাজ বেশ কিছু দূর অগ্রসর হয়েছিল। আজ তাঁর সেই থিসিস আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই তিনি মারা গেলেন ওই বছর। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি যে সংগঠনের পাশাপাশি নতুন তত্ত্ব নির্মাণের প্রতিও ফরহাদের সুতীক্ষ্ণ নজরদারি ছিল। জাতীয় গণতন্ত্র বা ন্যাশনাল ডেমোক্রেসির অর্থশাস্ত্র গড়ে উঠুক, এ কথা তিনি অনেকবার বলেছিলেন। পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক ফ্রি-মার্কেট ক্যাপিটালিজমের পথেও নয়, আবার পূর্ব এশিয়ার অনুদার স্টেট ক্যাপিটালিজমের ছকেও নয়—এ দুইয়ের মাঝখানে একটি তৃতীয় ছকে এগোতে পারবে অন্য বাংলাদেশ, এই আস্থা তাঁর ছিল। তাঁর এই চিন্তা বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের পিছু হটার পরিবেশে এখন আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৪.
এলোমেলো জীবন ছিল না তাঁর, এলোমেলো কোনো সংগঠন তিনি পেছনে রেখে যাননি। তিনি যখন আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন, তখন একটাও গণসংগঠন ছিল না বিশৃঙ্খল অবস্থায়। ছাত্র, যুব, মহিলা, কৃষক, খেতমজুর, শ্রমিক, সাংবাদিক, পেশাজীবী, মৈত্রী, সংহতি, অর্থনীতি—কোনো খাতেই যেসব গণসংগঠন ক্রিয়াশীল ছিল, তাদের ন্যুব্জপ্রায় বা ভঙ্গুর অবস্থা ছিল না। বরং ঠিক উল্টোটা। এসব খাতেই নজর কাড়ার মতো বর্ধিষ্ণুতা ও চলিষ্ণুতা ছিল। বিটোফেনের সিম্ফনির মতো সেসব প্রতিষ্ঠান তাঁর মুগ্ধ সঞ্চালনায় বেজে উঠেছিল। সেসব খাত, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা এখন সমাজ-রাষ্ট্রের নানা বৃত্তে ছড়িয়ে আছেন আপন আপন প্রতিভায়। শুধু প্রতিভাহীন মৃত্যু ঘটেছে তাঁর একান্ত প্রিয় প্রাণকেন্দ্রের। আজ যদি সেই সব প্রতিষ্ঠানের কর্মব্যস্ততা ‘এলোমেলো’ হয়ে থাকে, তবে সে জন্য তাঁকে দায়বদ্ধ করা চলে না। যদি পথের চলা নির্বিঘ্ন করার জন্য বহির্মহলের সাজসজ্জায় পরিবর্তন আনতে হয়, তার বিপক্ষে ছিলেন না তিনি। সমাজতন্ত্রকে পুনর্চিন্তনের জন্য পোস্ট-ক্যাপিটালিজমের ধারায় যদি প্রকল্পটিকে এবার এগিয়ে নিতে হয়, তাতেও তাঁর সায় থাকত আজ। যদি জাতীয় গণতন্ত্রের প্রয়োজনে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ধ্যানধারণা বিবেচনা করে ধর্মনিরপেক্ষতা-উত্তর সমাজ ও রাজনীতিকে দাঁড় করাতে হয়, তাতেও তিনি পিছু হটতেন না বোধ করি। কেননা, যতটুকু আমি তাঁকে দেখেছিলাম, তিনি ছিলেন একজন মাস্টার স্ট্র্যাটেজিস্ট। শুভ ও অশুভের লড়াইয়ে যেকোনো কৌশলই বিবেচ্য চাণক্য, এ নীতি তিনি মানতেন। তিনি বিপ্লবকে ছেড়ে যাননি, বিপ্লবীরা তাঁকে ছেড়ে গেছেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এই পশ্চাদপসরণ সাময়িক। যে পথ দিয়ে আমরা পাহাড়ের শিখরে পৌঁছাতে চেয়েছিলাম, অনেক দূর গিয়ে দেখা যাচ্ছে যে সেই পথ একটি ‘ডেড-এন্ড’-এ থুবড়ে পড়েছে। সেই অবস্থান থেকে আমাদের এখন বেশ কিছুটা পিছু হটে নতুন একটি পথ ধরে যাত্রা শুরু করতে হবে। ওই ডেড-এন্ড না এলে নতুন পথটিরও আভাস মিলত না, এটাও সত্যি। ফরহাদ বলছেন, ‘কমরেড, লেনিনের “নোটস অব আ পাবলিসিস্ট” পড়ে দেখুন। উত্তর পাবেন।’

বিনায়ক সেন: অর্থনীতিবিদ