কেমন আছে কাজী মোতাহার হোসেন ছাত্রাবাস

ড. কাজী মোতাহার হোসেন ছাত্রাবাস
ড. কাজী মোতাহার হোসেন ছাত্রাবাস

মাঠের এক ধারে পাকুড়গাছের সংসার। ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে মাটি থেকে সোজা উঠে গেছে শূন্যে। নিচের দিকটা ছিমছাম হলেও ডালপালার সংসার ছড়িয়েছে মাঠের অর্ধেকটা জুড়ে। তার বিপরীতেই দাঁড়িয়ে ‘ড. কাজী মোতাহার হোসেন ছাত্রাবাস’।

তেজগাঁওয়ে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের এই ছাত্রাবাস কবে স্থাপিত হয়েছে, তা ঠিক করে বলতে পারেননি কেউ। ধারণা করা হচ্ছে, ১৯৮১-৮২ সাল থেকে এটি ছাত্রদের থাকার জন্য খুলে দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালের ৯ অক্টোবর প্রয়াত হন কাজী মোতাহার হোসেন। খুব সম্ভব তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে ওই বছর বা তার পরে ছাত্রাবাসটির নামকরণ করা হয়। স্থানীয় এক প্রবীণ বললেন, পাকুড়গাছটির বয়সও চার দশকের কম হবে না।

পাকুড়ের মতো ভবনের গায়েও বয়সের ছাপ। কিছু রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হয়েছে। ধূসর আর লাল রঙের ঔজ্জ্বল্য তা-ই বলছে। ভবনের সামনে বৃত্তাকার ফোয়ারা। জল জমে আছে তলানিতে। কাঁটাতারে ঘেরা। ছাত্রাবাসের সুপার (তত্ত্বাবধায়ক) রফিকুজ্জামান খান জানালেন, ফোয়ারাটি সচল আছে। তবে সব সময় চালানো হয় না।

কলাপসিবল গেট পেরিয়ে ছাত্রাবাসের নিচতলায় হাতের ডানে নামফলক টাঙানো। ‘তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয়’। ঢুকতেই চোখ গেল একটি ছবিতে। কলমের আঁচড়ে আঁকা মুখ। শ্মশ্রুমণ্ডিত। ছাঁটা গোঁফ। কপালে দুটো ভাঁজ। চোখের নিচে বলিরেখা। চুলগুলো পেছনে সরে গেছে। চোখ দুটো অপলক সুদূরপানে। এই বিদ্বজ্জন মানুষটিই কাজী মোতাহার হোসেন। খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। যিনি ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই জন্ম নেন কুষ্টিয়া জেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে। সেখানে ছিল তাঁর মামাবাড়ি। নিজের বাড়ি ছিল পাংশার হাবাসপুর বাগমারা গ্রামে। বর্তমানে পাংশা রাজবাড়ী জেলার অধীনে একটি উপজেলা।

তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয়ের দেয়ালে টাঙানো তালিকা বলছে, রফিকুজ্জামান খান এই ছাত্রাবাসের দায়িত্ব নিয়েছেন ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর। ওই সময় ভবনটির অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। তিনি ঘুরে ঘুরে দেখালেন পুরো ভবনটি। নিচতলার লম্বা বারান্দা দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে পিলার দেখছেন, এগুলোর পলেস্তারা খসে খসে পড়েছিল। লোহার গ্রিলগুলো ঝুরঝুরে হয়ে গিয়েছিল মরিচা পড়ে। শৌচাগার, খাবার ঘর, কোনোটাই দেখার মতো ছিল না। যাচ্ছেতাই অবস্থা। দেখে আমার খুব খারাপ লাগল। ভাবলাম, এত বড় একজন মনীষীর নাম বহন করে থাকা ছাত্রাবাসটি এভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে থাকবে? অধ্যক্ষকে বললাম। তিনি বেশ কিছু টাকা বরাদ্দ দিলেন। তা দিয়ে অল্প অল্প করে ভবনটির চেহারা ফেরানোর চেষ্টা করেছি।’

চারতলা ভবনটিতে আছে ১২৬টি ঘর। এর মধ্যে কার্যালয়ের জন্য ব্যবহার হচ্ছে দুটি। বাকিগুলোতে শিক্ষার্থীরা থাকছেন। খাবারের জন্য আলাদা ডাইনিংরুম একটি। চিত্তবিনোদনের জন্য একটি ঘর। ওখানে টিভি, পত্রিকা রাখা হয়। আছে খেলাধুলার ব্যবস্থাও।

ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ কাজী জাকির হোসেনও ছাত্রজীবনে এই ছাত্রাবাসে ছিলেন। কথায় কথায় বললেন, ‘ড. কাজী মোতাহার হোসেন ছাত্রাবাসের ছাত্র—পরিচয় দিতে গেলে একধরনের ভালো লাগা কাজ করত ভেতরে। কারণ, তখন কেবল মেধাবী শিক্ষার্থীরা এই ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ পেত। এক ঘরে দুজন থাকত। দেয়ালের ভেতরে তাক করা দুটো আলমারি, দুটো বিছানা, দুটো টেবিল-চেয়ার—এই ছিল আসবাব।’ ঘুরে দেখা গেল, এখনো আসবাব একই আছে। তবে ছাত্রসংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রতিটি ঘরে থাকতে হচ্ছে তিন-চারজন শিক্ষার্থীকে।

প্রতিটি তলার নকশা একই। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠোনের মতো খোলা জায়গা। ইস্পাতের ফ্রেমে কাচের দেয়াল। অনেক জায়গায় কাচ ভেঙে গেছে। ফাঁক গলিয়ে উঁকি দিচ্ছে সবুজ পাতা, দিনের আলো। হাতের ডানে লম্বা খোলা বারান্দা। দিনের আলো এসে পড়ছে সহসা। দক্ষিণমুখো সারি সারি ঘর। বাইরের দেয়ালে ঘিয়ে রং। ভেতরটা হালকা সবুজ। বিবর্ণ চেহারা বলছে ভেতরে পড়েনি যত্নের হাত। এখানকার নিবাসী প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আরমানের সঙ্গে কথা হলো। ‘কাজী মোতাহার হোসেন কে ছিলেন বলতে পারো?’ জবাবে বললেন, ‘তিনি অনেক বড় মানুষ ছিলেন জানি। এর বেশি কিছু জানার সুযোগ হয়নি।’

ছাত্রাবাসের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক জিনদার হোসেন খান বললেন, ‘কাজী মোতাহার হোসেনকে জানার জন্য এখানে আসলে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। একটা লাইব্রেরি করতে পারলে ভালো হতো। যেখানে শিক্ষার্থীরা তাঁর লেখা বইপত্র পড়তে পারত।’

সিঁড়ি ভেঙে নিচে আসতে আসতে রফিকুজ্জামান বললেন, ‘সামনের খেলার মাঠটা অনেক কষ্টে অক্ষত রেখেছি। কতবার যে এটি দখলের পাঁয়তারা হয়েছে। মাঠটি দখল হয়ে গেলে ছাত্রাবাসে অন্ধকার নেমে আসবে। আকাশ দেখার ফুরসতটুকুও থাকবে না। ছেলেরা এখানে ঘুরে বেড়ায়। খোলা পরিবেশে শ্বাস নেয়। তা আর হবে না। এটা ভাবতে খুব খারাপ লাগে।’ বলতে বলতে তাঁর কণ্ঠ ধরে এল। তিনি নিঃশব্দে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলেন। মিহিদানা বৃষ্টি শুরু হলো। আমরা যে যার পথে চলে গেলাম। তখনো চোখে ভাসছিল, এফ এম বাবু নামে এক শিক্ষার্থীর আঁকা কাজী মোতাহার হোসেনের মুখাবয়ব। ভাবছিলাম, কতটা ভালোবাসা থাকলে কলমের কালিতে এভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় মানুষের মুখ!

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ: সাংবাদিক