বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক জোরদারে দিল্লিকে এগিয়ে থাকতে হবে

ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। পিআইডি ফাইল ছবি।
ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। পিআইডি ফাইল ছবি।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে এসেছিলেন। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলাপ–আলোচনার বাইরেও তিনি বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামের ভারত অর্থনীতি ফোরামের সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছেন।

শেখ হাসিনার সফর শেষে যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে বন্দর ও সংযোগব্যবস্থা, পানি ভাগাভাগি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি ইস্যুতে মতৈক্যের কথা বলা হয়েছে। ভারতের সঙ্গে আলোচনায় মিয়ানমারের রাখাইন থেকে ‘জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা’ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশার কথা উঠে আসাকে বড় ধরনের অগ্রগতি বলা যায়। মিয়ানমারের ভাষ্য ত্বরিত গতিতে বিশ্বাস করে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা তার নিজের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যতটুকু ক্ষতি করেছিল, তা অনেকটাই পূরণ হয়েছে।

২০১০ সালে শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে যে ভিশন তুলে ধরা হয়েছিল,এবারের যৌথ বিবৃতিতেযদি তা অনুপস্থিত থাকত, তাহলে বিগত সন্দেহ ও অবিশ্বাসের স্মৃতিকে আরও একবার সামনে নিয়ে আসত। তবে এখন সম্পর্ক অনেক পরিণত হয়েছে এবং উভয় দেশই পারস্পরিক নির্ভরতার গুরুত্বকে অনুধাবন করতে পারছে।

এবারের ইন্দো-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরামে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক কল্যাণের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। প্রথম প্রেসক্রিপশন হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের অবশ্যই সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে...বহুত্ববাদকে শক্তিশালী করতে হবে। এটি করতে পারলেই আমরা দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মীয়, জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্র্যকে উপভোগ করতে পারব।’ তাঁর এই বক্তব্য তাঁর নিজের দেশের জনগণের কাছে হয়তো গ্রহণযোগ্য, কিন্তু আজকের ভারতের বাস্তবতায় এই বক্তব্যকে ভারতের ক্ষমতাসীন নেতারা তাঁদের প্রতি শেখ হাসিনার চাপা তিরস্কার হিসেবে দেখে থাকতে পারেন।

শেখ হাসিনার আরেকটি প্রেসক্রিপশন হলো—‘আমাদের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অবশ্যই বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সামাল দিতে হবে। তাই আসুন, আমরা আমাদের জনগণের স্বার্থে আমাদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ভারসাম্যপূর্ণ করে তুলি। আমরা তাৎক্ষণিক লাভের জন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে বেচে দিতে পারি না।’

শেখ হাসিনার এই বক্তব্য হয়তো মোটাদাগে গতানুগতিক ও মৌলিক কূটনৈতিক ভাষ্য। কিন্তু এভাবেও ভাবা যায় যে, শেখ হাসিনা এই বক্তব্যের মাধ্যমে তাঁর দেশের সেই সব মানুষকে খুশি করতে চেয়েছেন, যাঁদের ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মাখামাখির প্রতি বীতশ্রদ্ধা আছে।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে যে নির্বাচন হয়, তার কয়েক মাস আগে দেশটির কার্যত বিরোধী দল বিএনপির কয়েকজন সদস্য ভারত সফর করেছিলেন। তাঁরা ভারতের ক্ষমতাসীন নেতাদের দুটি বিষয় বোঝাতে এসেছিলেন। প্রথমত, তাঁরা বলেছিলেন, তাঁদের দল জনগণের সামনে ভারতবিরোধী যে অবস্থান তুলে ধরে থাকে, সে অবস্থান থেকে তারা সরে এসেছে এবং তারা যদি নির্বাচিত হয়, তাহলে তারা ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতেই পথ চলবে।

দ্বিতীয়ত, তাঁরা বোঝাতে চাইছিলেন আওয়ামী লীগ তার অপশাসনের কারণে জনসমর্থন হারিয়ে ফেলেছে এবং এ কারণে ভারতের নিজের স্বার্থেই আওয়ামী লীগকে ভারতের আর সমর্থন দেওয়া ঠিক হবে না। ভারতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ তখন বিএনপির এই যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নিয়েছিলেন।

আদতে বাংলাদেশে জনগণই তাদের সরকারকে বেছে নেয় এবং দেশটির নির্বাচিত সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থন থাকলে সেটিকে তার বাড়তি ক্ষমতা হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। তবে এ কথাও ঠিক, ভারতের সায় দেওয়া না–দেওয়ার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির প্রতি ভারতের ছদ্ম সমর্থন ছিল এবং সেই সমর্থন নির্বাচনের ফলের ওপর যে প্রভাব ফেলেছিল, সেটিকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না।

 এখন দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগের জনসমর্থনে ভাটা পড়তে পারে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে জিডিপি বাড়া থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে দলটি এখনো ভালো করে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, দলটি সফলভাবে বিদেশি মদদপুষ্ট জঙ্গিদের দমন করে রাখতে সক্ষম হয়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগে যে অবস্থা ছিল, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় মদদে মৌলবাদের উত্থানে যে অসহায় অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তা যে কেউ স্মরণ করতে পারেন।

বাংলাদেশে সরকারের সমালোচনা সহ্য না করার বিষয়ে এখন কথা উঠছে। শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে করা মামলা উদাহরণ হিসেবে আনা যেতে পারে। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, এটি এমনই একটি বিষয়, যা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে ভারতের পরামর্শ দিতে যাওয়া মোটেও উচিত নয়।

কয়েক মাস ধরে ভারতের নাগরিক তালিকা নিয়ে বাংলাদেশের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে। বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে, এ নিয়ে তাদের বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। আসামের নাগরিক জরিপ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি সাপেক্ষে আসামে নাগরিক তালিকা (এনআরসি) হচ্ছে। তবে যাঁরা বাদ পড়ছেন, তাঁদের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে আবেদন করার সুযোগ রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব বলেছেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে ভালো। তবে একই সঙ্গে আমরা চোখ খোলা রেখে এনআরসির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি।’ এখানে ‘বর্তমানে’ এবং ‘আমাদের চোখ খোলা রেখে’—এই শব্দগুলো তিনি অসতর্কভাবে আওড়ে গেছেন, তা মনে করার কারণ নেই।

আসলে ভারতের অভ্যন্তরীণ ভোটের রাজনীতির অংশ হিসেবে সে দেশের সব রাজ্যে এনআরসি করা হতে পারে এবং তা করা হলে অবধারিতভাবে বাংলাদেশ প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে দাঁড়াবে এবং তখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হবে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ব্যালান্স শিটের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশেরই লাভের পাল্লা ভারী। দুই দেশের সম্পর্কে যে ‘দূষণ’ ছিল, গঙ্গা পানিচুক্তির মাধ্যমে তা দূরীভূত হয়েছে।

দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ইস্যুগুলো বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনা গঠনমূলকভাবে বড় ধরনের রাজনৈতিক সাহস দেখিয়ে যাচ্ছেন।

দুই দেশের মধ্যে স্থল ও নৌ সীমানা চুক্তিতে উভয় দেশই উপকৃত হবে। স্থল চুক্তিটি উভয় পক্ষের গাফিলতির কারণে দীর্ঘদিন ঝুলেছিল এবং বিজেপি সরকার এটি টানা চার বছর পার্লামেন্টে ঝুলিয়ে রেখেছিল। অবশেষে তা হয়েছে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে দিল্লি দীর্ঘদিন ধরে চিন্তায় আছে। তারা যাতে কোনো সমর্থন না পায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ভারতকে আশ্বস্ত করতে পেরেছে বলে মনে হয়।

তবে ভারতের দিক থেকে এখনো তিস্তার পানি দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করে যাওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশের গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের অর্থনৈতিক সুবিধার দিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। কিন্তু ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্পে সায় না দেওয়ায় প্রকল্পটিতে বাংলাদেশ কোনো বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারছে না।

ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যেসব বিদ্বেষমূলক ঘটনা ও প্রচার চলছে, বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তার প্রভাব না পড়ার কারণ নেই। তবে আওয়ামী লীগকে কৃতিত্ব দিতেই হয়, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর দেশটিতে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল, এখনো তেমন কিছু ঘটেনি। তবে হয়তো ধীর ধীরে সে সলতে জ্বলে উঠতে পারে।

ভারতে অভ্যন্তরীণ বিদ্বেষমূলক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যেন আমাদের প্রতিবেশীর সঙ্গে গড়ে তোলা সুসম্পর্কের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে, আমরা আন্তরিকভাবে সেটাই আশা করব।

(লেখাটি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। তাদের অনুমতিক্রমে বাংলায় অনুবাদ করে ছাপা হলো।)

দেব মুখার্জি বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার