অনিরাপদ শিক্ষাঙ্গন

বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের খুনিরা চিহ্নিত হয়েছেন, বেশির ভাগ অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন। আইন নিজের মতো চললে সবাইকে গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে। কিন্তু আইন নিজের মতো চলবে বা খুনিরা সত্যি সত্যি শাস্তি পাবেন—এ ব্যাপারে সন্দেহমুক্ত থাকা যাচ্ছে না। গতকালের প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন এবং সিলেটের শাহজালাল, লিডিং ও সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে একজন করে মোট ১৫ জন শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন; কিন্তু একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়নি।

আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদে শিক্ষাঙ্গনে আন্দোলন-বিক্ষোভ চলছে। বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখে তাঁদের মানসিক অবস্থা অনুধাবন করা কঠিন নয়। আবরারের অনেক সহপাঠী মিছিলে এসে, কথা বলতে গিয়ে কেঁদেছেন। কিন্তু তঁাদের এ কান্না কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে কি না, সেটা এক বড় প্রশ্ন। মন্ত্রী-নেতারা কোন আমলে কতটি খুন হয়েছে, কতটির বিচার হয়েছে কি হয়নি, তা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করছেন। এর মধ্যে দায় এড়ানোর প্রবণতা যেমন আছে, তেমনি ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে যা চলছে, তার প্রতি সমর্থনই প্রকাশ পাচ্ছে।

বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যে ১০ দফা দাবি পেশ করেছেন, তাতে আবরার হত্যার খুনিদের বিচারের দাবি রয়েছে। আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হলে খুনের বিচার হতেই হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গনে যে সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতার চিত্র তুলে ধরেছেন, তা ভয়াবহ। রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে আবাসিক হলে ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করা, নবীন শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, র‌্যাগিং, রাজনৈতিক সভা-মিছিলে যোগ দিতে বাধ্য করা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাধারণ ছাত্রদের ওপর নির্যাতন চালানো ও হল থেকে বিতাড়িত করার ঘটনায় তাঁরা বিক্ষুব্ধ।

২০০২ সালে বিএনপি সরকারের আমলে ছাত্রদলের দুই পক্ষের গোলাগুলিতে সাবিকুন নাহার ওরফে সনি নামের এক শিক্ষার্থীকে জীবন দিতে হয়। আর আওয়ামী লীগ আমলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করলেন আবরারকে। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীরা ১৫ অক্টোবরের মধ্যে বুয়েটে সব রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার যে দাবি তুলেছেন, তাকে অযৌক্তিক বলা যাবে না। আবরার হত্যার প্রতিবাদে মাঠে নেমেছেন বুয়েটের শিক্ষকেরাও। গতকাল শিক্ষক সমিতি উপাচার্যের পদত্যাগের পাশাপাশি দলীয় পরিচয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে।

রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির যে ছাত্ররাজনীতি ভিন্নমতের কারণে আরেকজন ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার পরিস্থিতি তৈরি করে বা যে ছাত্ররাজনীতি আবাসিক হলে নির্যাতন সেল তৈরি করে, সেই ছাত্ররাজনীতি চলতে পারে না। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের চাওয়া ও দাবি বিবেচনায় নিয়ে বুয়েট এবং এ ধরনের বিশেষায়িত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) বহু আলোচিত ’৭৩–এর বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন আইনের অধীনে নেওয়া হলেও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) নেওয়া হয়নি। ফলে এটি এখনো পরিচালিত হচ্ছে ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী। একইভাবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও (বাকৃবি) চলছে নিজস্ব আইনে। এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষায়িত বলেই সম্ভবত সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে ’৭৩–এর আইনের আওতায় আনা হয়নি। এসব বিবেচনায় বিশেষায়িত সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় পরিচয় ও প্রচলিত ছাত্রসংগঠনভিত্তিক ছাত্ররাজনীতিমুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা আশা করছি, বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।