রোহিঙ্গা শরণার্থী: মিয়ানমারকে আরও জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে

কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা বসতি। প্রথম আলো ফাইল ছবি
কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা বসতি। প্রথম আলো ফাইল ছবি

আমি বাংলাদেশের কক্সবাজার সফর থেকে মাত্র ফিরলাম। ২০১৭ সালে এখানে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে সহিংসতার শিকার হয়ে পালিয়ে এসেছে। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা এখানকার শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। এখানে এসে নিজ চোখে না দেখলে এই সংকটের ব্যাপ্তি অনুধাবন করা খুবই কঠিন। যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় খাদ্য, আশ্রয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন, যৌন সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের সহায়তা, এবং অসহায় নারী ও কন্যাশিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। এই সহায়তা কী ফলাফল এনেছে তা দেখতে আমি শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে গিয়েছিলাম।

আমি সফর শুরু করি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার রেজিস্ট্রেশন সেন্টার থেকে। এর আগে অনেক শরণার্থীকে কখনো কোনো সঠিক পরিচয় প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হয়নি। এই রেজিস্ট্রেশন সেন্টার থেকে রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র প্রদান করা হয়। এর পাশাপাশি এই রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার অধিকার ও তাদের পরিবারের সঙ্গে বসবাস নিশ্চিত করবে। ইতিমধ্যে ৬ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী নিবন্ধিত হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়া শিগগিরই শেষ হবে।

শরণার্থী শিবিরে নারী ও শিশুরা অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন সহিংসতার শিকার হয়। কিন্তু যেকোনো মানবিক সংকটের প্রেক্ষাপটে তা দ্বিগুণ আকার ধারণ করতে পারে। এই সফরে আমি ইউকে এইডের সহায়তায় পরিচালিত একটি নারীবান্ধব কেন্দ্রও পরিদর্শন করেছি, যা ক্যাম্প স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা সুরক্ষিত। আমার এমন কয়েকজন নারীর সঙ্গে পরিচয় হয়, যাঁরা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন ও নিজেরাও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। সেই নারীরা এখনো সেই মানসিক আঘাত সামলে ওঠার চেষ্টা করছেন।

পারিবারিক সহিংসতা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটি বড় সমস্যা—এই উপায়ে অনেক পুরুষই স্ত্রীর ওপর তাদের হতাশা প্রকাশ করার চেষ্টা করে। এই নারীবান্ধব কেন্দ্রগুলো ক্যাম্পে বসবাসরত নারীদের জন্য এমন একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে, যেখানে তারা কোনো ভীতি ছাড়া কথা বলতে পারে, স্বাস্থ্যসেবার মতো প্রয়োজনীয় সেবা গ্রহণের সুযোগ পায়। যখন আমি সেই নারীদের সঙ্গে কথা বললাম, তখন তাঁরা বললেন, যত দ্রুত সম্ভব তাঁরা নিজ বাসভূমিতে ফেরত যেতে চান। তবে তাঁরা তখনই ফেরত যাবেন, যখন তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের জন্য ফিরে যাওয়া নিরাপদ হবে।

অভিভাবকেরাও তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। এ ধরনের মানবিক সংকটে পতিত পরিবারগুলো মনে করে খাদ্যের মতোই তাদের সন্তানদের শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার সুযোগ একটি উদ্বেগের বিষয়, কেননা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শতকরা ৫৮ শতাংশেরই বয়স ২৪ বছরের নিচে।

আমি এবার ইউনিসেফের একটি লার্নিং সেন্টারও পরিদর্শন করি। উল্লেখ্য, ইউকে এইডের সহায়তায় কক্সবাজারে এমন ১৫০টি লার্নিং সেন্টার স্থাপিত হয়েছে। পরিদর্শনকালে শিশুরা আমাকে আনন্দের গান গেয়ে শোনায়। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, আমার ক্যাম্প সফরের সেই দিনটিতে আমি হাসির শব্দ শুনতে পাই। লার্নিং সেন্টার থেকে জানতে পারলাম রোহিঙ্গাদের ভাষার কোনো নিজস্ব অক্ষর বা বর্ণ নেই, কিন্তু তারা বার্মিজ ভাষা শিখছে যেন তা মিয়ানমারে ফিরে যেতে সহায়ক হয়। কেবল শিশুদের শরণার্থী শিবিরে নিরাপদ রাখতে নয়, শিক্ষা নিজ ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের মনে আশাও জাগায়।

এ সফরের মাধ্যমে আজ আমি ইউকে এইডের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় আরও ৩০ মিলিয়ন পাউন্ড সহায়তা ঘোষণা করেছি। ২০১৭ সাল থেকে আজ অবধি আমরা ২৭ হাজার শিশুকে শিক্ষার জন্য সহায়তা প্রদান করেছি। এ ক্ষেত্রে আমাদের সহায়তা বৃদ্ধির ফলে আরও ৭৫ হাজার শিশু শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে। এর পাশাপাশি আমরা আরও বেশি সংখ্যক নারীবান্ধব কেন্দ্র স্থাপনেরও সুযোগ পাব।

বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান করে এক অনন্য মানবিকতা প্রদর্শন করেছে। তবে এই সংকটের ফলে বাংলাদেশের যেসব মানুষ প্রভাবিত হয়েছে, তাদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। আমরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি শরণার্থীশিবিরের আশপাশে বসবাসকারী স্থানীয় জনগণকেও সহায়তা করছি। আমরা একই সঙ্গে স্থানীয় সুবিধাবঞ্চিত নারীদের ব্যবসার জন্য দক্ষতা বৃদ্ধি, স্থানীয় অর্থনীতি জোরালোকরণ এবং স্থানীয় জনগণ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনে ভূমিকা রাখছি।

বাংলাদেশ সফর শেষে আমি মিয়ানমারে গিয়ে দেখেছি ৭০ বছরের গৃহযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট সমস্যা এবং ৫০ বছরের পুরোনো সামরিক শাসন। সেখানে এমন কিছু দীর্ঘমেয়াদি ও গভীর সমস্যা রয়েছে, যার সমাধান করতে অত্যন্ত ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। রাখাইন প্রদেশের অবস্থাটি ঠিক এমনই। যুক্তরাজ্য মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে নাজুক অবস্থায় থাকা মানুষকে সাহায্য করে যাবে এবং মিয়ানমার যেন নিজ দেশে এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই সমাধান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবর্তন আনতে পারে, সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবে।

রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে আসার জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির যে সুপারিশ রাখাইন উপদেষ্টা কমিটি করেছে তা বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকার কিছু অগ্রগতি দেখিয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের আরও জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে নিবন্ধন, নারীবান্ধব কেন্দ্রের প্রশান্তি কিংবা লার্নিং সেন্টারের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের হাতছানি—আমি নিজ চোখে দেখেছি ইউকে এইড কীভাবে সত্যিকার অর্থেই পরিবর্তন আনছে।

নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গারা নিজ জন্মভূমিতে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু সেই ফিরে যাওয়া হতে হবে নিরাপদ, স্বেচ্ছায় ও মর্যাদার সঙ্গে। যত দিন পর্যন্ত তা নিশ্চিত না হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত কক্সবাজারে ও রাখাইনে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের জন্য আমাদের সহায়তা অব্যাহত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যারোনেস সাগ: যুক্তরাজ্যের দাতা সংস্থা ইউকে এইডের মন্ত্রী