সিরিয়ায় তুরস্কের অভিযান উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। রয়টার্স ফাইল ছবি
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। রয়টার্স ফাইল ছবি

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদে সিরিয়ায় একটি বিপজ্জনক খেলা শুরু করেছেন, যা কিনা তুরস্কের জন্য উল্টো ফল বয়ে আনতে এবং দেশটির নিরাপত্তাহীনতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। 

প্রতিবেশী দেশ সিরিয়ায় তুরস্কের সামরিক হস্তক্ষেপ অত্যন্ত সন্দেহজনক। সিরিয়ার সঙ্গে ৯০০ কিলোমিটারের চেয়ে বেশি সীমান্ত এলাকাজুড়ে ‘সন্ত্রাসী কার্যক্রমের করিডর’ বন্ধ করার জন্য এবং লাখ লাখ সিরীয় শরণার্থীর প্রত্যাবাসনের জন্য একটি ‘সেফ জোন’ বা নিরাপদ এলাকা তৈরি করার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। 

তুরস্কের সরকারি সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলনে সিরিয়ার কুর্দি–নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডের ৪৬০ কিলোমিটার এলাকা দখল করার তুরস্কের পরিকল্পনার মানচিত্রটি উত্থাপন করা হয়। এই মানচিত্র বিশ্বকে দেখিয়েছে, এরদোয়ান কীভাবে সিরিয়ার অভ্যন্তরে একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গড়তে চান এবং সেই অঞ্চলে তুরস্কে থাকা সিরীয় শরণার্থীদের পুনর্বাসন করতে চান। 

যদি এই পরিকল্পনা সফল হয়, তবে তুরস্ক সিরিয়ার বেশির ভাগ তেল ও গ্যাস সম্পদ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে, যা কিনা বর্তমানে কুর্দি–নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের (এসডিএফ) হাতে রয়েছে। 

২০১৮ সালের আফরিন অভিযানের অনুকরণে সিরিয়ায় তুরস্কের এই ‘স্প্রিং অব পিস অপারেশন’ অভিযান চালানো হচ্ছে। আফরিন অভিযানে স্থানীয় জনগণের ওপর ব্যাপক অত্যাচার চালানো হয়। অধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এই অভিযানের কারণে সেখান থেকে বহু মানুষ চলে যেতে বাধ্য হয়। 

তবে এই অভিযানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন কুর্দিদের সঙ্গে তার বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। কেননা, গত পাঁচ বছর ধরে আইএসবিরোধী লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্রের ভূমিকা রেখেছে কুর্দিরা। মার্কিন নেতৃত্বাধীন অভিযানে তারা ১১ হাজার সেনা খুইয়েছে। 

অবশ্য এই প্রথম কোনো রাষ্ট্র অন্য কোনো দেশে হামলা চালাচ্ছে, তা নয়। ১৯৮০–এর দশকে সাদ্দাম হোসেনের ইরানের ওপর হামলার কথা স্মরণ করুন, তখন বলা হয়েছিল খুজেস্তানে ইরানি আরবদের ‘মুক্ত’ করার জন্য এই অভিযান। আসলে তাদের লক্ষ্য ছিল ইরানের তেল এবং খুজেস্তানে ইরাকের বেশির ভাগ তেলক্ষেত্র অবস্থিত। 

তুরস্ক সিরিয়ায় অভিযান চালানোর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সেখান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করেনি। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে দুটি বিমানঘাঁটিসহ এখনো প্রায় ১৮টি মার্কিন ঘাঁটি এবং অপারেশন পয়েন্ট রয়েছে এবং ট্রাম্পের বহুল প্রচারিত সেনা প্রত্যাহারে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। 

গত ডিসেম্বর মাসে ট্রাম্প প্রথমে সিরিয়ার কুর্দি–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে এই সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিলেন, যার জেরে তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিসকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। 

তুরস্কের সিরিয়া নীতিমালার মূল ত্রুটিটি হলো, এটা এই বিষয়টিকে উপেক্ষা করেছে যে নিরাপত্তা হচ্ছে একটি দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়া। তুরস্ক নিজের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সিরিয়ার অভ্যন্তরে নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে তুলতে পারে না। এই অভিযানে ইতিমধ্যে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে এবং ৬০ হাজারের বেশি মানুষ পালিয়েছে। 

তুরস্ক সিরিয়ার সঙ্গে সীমান্তে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা করেছে, সেটা হবে দামেস্কের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারবিরোধী গোষ্ঠীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এই গোষ্ঠীগুলোর তুরস্কের প্রতি খুব কমই আনুগত্য রয়েছে এবং তারা তাদের নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য কৌশলগত জোটে রয়েছে। 

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এই অভিযানের ফলে সিরিয়ার কুর্দি–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের আইএস জঙ্গিরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কেননা, তুরস্কের বাহিনীর আক্রমণের মুখে কুর্দি যোদ্ধাদের প্রধান কাজ হবে আত্মরক্ষা এবং পাল্টা আক্রমণ। আইএস যোদ্ধাদের কারাগার পাহারা দেওয়াটা তাদের একটা গৌণ কাজ হয়ে পড়বে। একটা কারা-বিদ্রোহ ঘটিয়ে ফেলতে পারে, জেল ভেঙে বেরিয়ে যেতে পারে। এই আইএস যোদ্ধারা আটকাবস্থা থেকে বের হতে পারলে তাদের অনেকে হয়তো নানা পথ দিয়ে ইউরোপে বা তাদের নিজ দেশে চলে আসবে এবং লন্ডন, প্যারিস বা বার্সেলোনার ঘটনার মতো বড় আকারের আক্রমণের পরিকল্পনা শুরু করবে। 

তুরস্কের সিরিয়া পরিকল্পনার আর একটি প্রধান ত্রুটি হলো, কুর্দিদের লড়াই করার ক্ষমতাকে ছোট করে দেখা। যেমনটা ইয়েমেন হুতি বিদ্রোহীদের ক্ষেত্রে করেছিল। 

অভিযানের পক্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি না দিলেও ন্যাটো আঙ্কারাকে সমর্থন করছে। রাশিয়া অবশ্য সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে তুরস্কের প্রতি। তবে নিজের নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা বলে এভাবে অন্য রাষ্ট্রে হামলা চালানো রীতিমতো অনৈতিক। তুরস্ক এটা করতে পারে না। এই অভিযান তুরস্কের জন্য উল্টো ফলও বয়ে আনতে পারে।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

কাভেহ আফরাসিয়াবি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক