উপাচার্যদের জবাবদিহি

শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদ নামের এক শিক্ষার্থী দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) প্রশাসন, বিশেষ করে উপাচার্য সাইফুল ইসলাম যে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন, তা অমার্জনীয়। এতে শুধু শিক্ষাঙ্গন নয়, সারা দেশেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। উপাচার্য এতটাই ‘দায়িত্ববান’ যে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলে একজন শিক্ষার্থীকে হত্যার পরও ঘটনাস্থলে কিংবা তাঁর জানাজায় হাজির হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি তিনি। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক। এ কেমন অভিভাবকসুলভ আচরণ?

ঘটনাস্থলে না যাওয়া সম্পর্কে উপাচার্য যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তিনি বলেছেন, ওই সময় তিনি শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হলেন, তখন তাঁর কাছে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে?  শিক্ষার্থীরা যখন উপাচার্যের অফিস ঘেরাও করেন, তখনো তাঁর আচরণ ও ভাষাভঙ্গিতে একধরনের নির্লিপ্ততা দেখা গেছে। পরে শিক্ষার্থীদের কঠোর ও লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য তাঁদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে এবং শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

দীর্ঘদিন ধরে বুয়েটে সরকারি ছাত্রসংগঠনটি অত্যাচার-নির্যাতন চালালেও সাম্প্রতিক কালে এর মাত্রা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এ অবস্থায় সাইফুল ইসলামের উপাচার্য পদে থাকার নৈতিক অধিকার আছে কি না, সেই প্রশ্নও এসেছে। ইতিমধ্যে বুয়েট শিক্ষক সমিতির ব্যানারে ৩০০ শিক্ষক সমাবেশ করে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছেন। এর আগে জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ক্যাম্পাসে সমাবেশ করে আবরার হত্যার প্রতিবাদ ও উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেছে।

 বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি যা বলেছেন, তা অযৌক্তিক ও অনভিপ্রেত। অস্বীকার করা যাবে না যে বুয়েট কিংবা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত র‌্যাগিং বা নির্যাতন সেল বন্ধ করতে না পারা সম্মিলিত ব্যর্থতা। কিন্তু এ বিষয়ে বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ে নিশ্চয়ই শিক্ষামন্ত্রী ও বুয়েটের উপাচার্যের দায়িত্ব অনেক বেশি ছিল। অতএব, শিক্ষক সমিতি ও বুয়েট অ্যালামনাই উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করে কোনো অন্যায় করেনি। বরং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মতামত উপেক্ষা করে উপাচার্য যদি গদি রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন, তার পরিণতি ভালো হতে পারে না।

বুয়েটের ঘটনা আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও উপাচার্যদের মেরুদণ্ডহীন চরিত্র উন্মোচিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা কিসের ভিত্তিতে নিয়োগ পান? এ ক্ষেত্রে মেধা-যোগ্যতা নয়, দলীয় আনুগত্য অগ্রাধিকার পায় বলে প্রমাণ আছে। ফলে পদায়িত হয়েই তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়কে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার চেয়ে নিজের দল ভারী করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কোন উপাচার্যের কতটি ডিগ্রি আছে, সেটি মুখ্য না হয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে তিনি কতটা ক্ষমতাসীন দলের প্রতি অনুগত।

সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে অবমাননাকরভাবে বিদায় নিয়েছেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। এর আগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইমামুল হকও পদত্যাগে বাধ্য হন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও সহ–উপাচার্যদের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করা উচিত। সেই সঙ্গে তাঁদের নিয়োগপ্রক্রিয়াটি নিয়েও নতুন করে ভেবে দেখা প্রয়োজন। উপাচার্যদের জবাবদিহি
থাকতেই হবে।

 নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে ইতিমধ্যে শেরেবাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছেন। এ অবস্থায় বুয়েটে সুস্থ ও স্বাভাবিক
পরিবেশ ফিরিয়ে আনার স্বার্থে উপাচার্য সাইফুল ইসলামের পদত্যাগের বিকল্প নেই।