যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো আজ ভোরে

দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছিলেন, ‘এই পৃথিবী আমরা পূর্বপুরুষদের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাইনি, বরং আমরা এটাকে ধার নিয়েছি আমাদের উত্তর প্রজন্ম থেকে।’ কাজেই এই ধার করা পৃথিবীকে যেভাবে পেয়েছি, তার চেয়ে ভালো এবং ভবিষ্যতের জন্য উপযোগী করে হস্তান্তর করে যাওয়ার নৈতিক দায় আমাদের। 

যে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে আজ ভোরে, সে শুধু শারীরবৃত্তিক কর্মকাণ্ডসম্পন্ন একটা জীব নয়, সে এসেছে কতগুলো অধিকার নিয়ে—সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার, সুশিক্ষা পাওয়ার অধিকার ও সুরক্ষিত হয়ে বেড়ে ওঠার অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করতে হলে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করতে হবে, আর সে জন্য মানবশিশুর দেহটিকে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে হবে। এই সম্পদ রাতারাতি তৈরি হবে না। শিশুদের এই অধিকারগুলো রক্ষায় আজকে আমরা কী পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ করছি, তার ওপর নির্ভর করছে ত্রিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর পর বাংলাদেশ কেমন থাকবে। এটা শুধুই আশা-আকাঙ্ক্ষার আবেগতাড়িত বাণী চয়ন নয়, এটা নির্জলা বিজ্ঞান। শিশু অধিকার এখনো বহুলাংশে একটি অধরা ধারণা হয়ে আছে। আমি শিশু অধিকার বাস্তবায়নে মানবসম্পদ উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করার অনেক প্রায়োগিক সুবিধা দেখতে পাচ্ছি। এতে শিশু অধিকারের বনিয়াদি বিষয়গুলোকে পরিকল্পনা, পরিমাপ ও জবাবদিহির নিরিখে ব্যাখ্যা করা যাবে। 

গত বছর বিশ্বব্যাংক প্রথমবারের মতো মানবসম্পদ সূচক প্রকাশ করেছে। পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুর বাঁচার সম্ভাব্যতা, স্কুলে থাকার সম্ভাব্য সময় (বছর), বৈশ্বিক নিরিখে পড়াশোনার মান, গুণগত মান বিবেচনায় শিক্ষা–বছরের অবস্থান, অপুষ্টি ও প্রাপ্ত বয়সে বেঁচে থাকার সম্ভাব্যতা—এই ছয়টি পরিমাপের জটিল সমন্বয় হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচক। এটি নির্ভর করে শিশুকাল থেকে বছরের পর বছর ধরে সঞ্চয় করা জ্ঞান, দক্ষতা ও স্বাস্থ্যের সমন্বয়ের ওপর। যে শিশুটি আজ জন্ম নিল, সে যদি সবচেয়ে ভালো স্বাস্থ্য নিয়ে, সবচেয়ে ভালো মানের শিক্ষা নিয়ে বেড়ে ওঠে, তাহলে ১৮ বছর বয়সে যে কাঙ্ক্ষিত সামাজিক উৎপাদন ক্ষমতা তার থাকার কথা, তার তুলনায় এই সূচক নির্দেশ করে, বাস্তবে উৎপাদন ক্ষমতা কতটুকু আছে। ১৫৭টি দেশের বৈশ্বিক গড় শূন্য দশমিক ৬৭–এর বিপরীতে বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচক শূন্য দশমিক ৪৮ (১০৬তম)। তালিকায় সবচেয়ে ওপরে আছে সিঙ্গাপুর, শূন্য দশমিক ৮৮ আর সবচেয়ে নিচে আছে মধ্য আফ্রিকার দেশ চাদ, শূন্য দশমিক ২৯ নিয়ে। এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে ভারত শূন্য দশমিক ৪৪ আর পাকিস্তান শূন্য দশমিক ৩৯; জাপান, কোরিয়া, হংকং আছে শীর্ষ পাঁচে। 

এমডিজি যুগে শিশুমৃত্যুর হার কমানো ও শিশুদের স্কুলে নিয়ে আসার প্রতি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল এবং সার্বিকভাবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হলেও লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু সংখ্যা এবং গুণগত মানের ভারসাম্য রক্ষা করা যায়নি। এ দেশে এখনো পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রতি হাজার জীবিত জন্মে ৪১ জন শিশু মারা যায় পঞ্চম জন্মদিনের আগেই। আবার মৃত্যুহারকেই স্বাস্থ্য খাতের মূল অগ্রগতির সূচক বিবেচনার কারণে অপুষ্টি, মানসিক বিকাশ রয়ে গেছে মনোযোগের আড়ালে। ৩১ শতাংশ শিশু এখনো অপুষ্টির শিকার। যে শিশুটি ক্ষুধার্ত অবস্থায় স্কুলে যায় কিংবা দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টিতে ভুগছে, যত ভালো স্কুলেই তাকে দিই না কেন, তার শেখার মান ও ধারণ করার ক্ষমতা অনেক কম হবে। ২০১৫–এর জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন অনুযায়ী, তৃতীয় শ্রেণির ৬৫ শতাংশ শিশু বাংলায় কাঙ্ক্ষিত প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়, আর এই হার পঞ্চম শ্রেণিতে শতকরা ২৩ ভাগ। গণিতের ক্ষেত্রে এই অর্জনের হার তৃতীয় শ্রেণিতে ৪১ শতাংশ এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ১০ শতাংশ। অথচ প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় পাসের হার ৯০ শতাংশর ওপরে। কাকে ধোঁকা দিচ্ছি আমরা? নিজেদেরই নয় কি? 

মানবসম্পদ উন্নয়নের বিষয়টিকে শিশু অধিকার ও উন্নয়ন ভাবনার কেন্দ্রে আনতে হলে দুটো পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রথমত, উন্নয়ন পরিকল্পনায় এটিকে একটি সমন্বিত প্যাকেজ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে; দ্বিতীয়ত, একটি সমন্বিত সূচক হিসেবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উন্নয়ন অগ্রযাত্রার নিরীক্ষণের পরিমাপক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। 

শিশু বাজেট করতে গিয়ে আমরা দেখলাম, প্রায় ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে বিস্তৃত ও বিভাজিত হয়ে আছে শিশু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ও আহ্বানে, ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ নিউট্রিশন আর ডিপার্টমেন্ট অব প্রাইমারি এডুকেশন একসঙ্গে বসে স্কুলের বাচ্চাদের শারীরিক-মানসিক বিকাশের জন্য একটা সমন্বিত পরিকল্পনা করছে, যার অর্থায়ন হচ্ছে যৌথভাবে স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। এমনটাই তো হওয়া উচিত। 

৭ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া ধরে রাখা সম্ভব হবে না। নিশ্চিত হবে না আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ। দ্রুত পাল্টে যাওয়া পৃথিবীতে যে ধরনের দক্ষ জনগোষ্ঠীর দরকার, বিশেষায়িত দক্ষতা না নিয়ে বেড়ে উঠলে আমাদের সন্তানেরা বিশ্ব অর্থনীতিতে উপযুক্ত অবদান রাখতে পারবে না। রাজনীতিবিদেরা বড় সেতু, রাস্তা, মেট্রোরেলের মতো দৃশ্যমান প্রকল্প হাতে নিতে যত আগ্রহী, তার তিলমাত্রও আগ্রহী নন মানবসম্পদ উন্নয়নের বিনিয়োগে। কারণ, মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক বিনিয়োগে হাতেনাতে ফল পাওয়া যায় না। সদ্য সমাপ্ত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় আমাদের এই সামষ্টিক অদূরদর্শিতাকে যেন প্রতীকীভাবে শাসনের তর্জনী তুলে সতর্ক করা হলো। আসছে সব প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে গ্রেটা থুনবার্গ যেন শুধু জলবায়ু নয়, শিশুদের অধিকার আদায় ও সুন্দর ভবিষ্যৎ ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সবার নিস্পৃহতা এবং নিষ্ক্রিয়তাকে চোখ রাঙিয়ে বলেছে, ‘হাউ ডেয়ার ইউ?’ 

ইশতিয়াক মান্নান উন্নয়নকর্মী